ওলাইচণ্ডী
ওলাইচণ্ডী বা ওলাদেবী হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশে পূজিত এক লৌকিক দেবী। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ইনি ওলাবিবি নামে পরিচিত। লোকবিশ্বাস অনুসারে, ইনি ওলাওঠা (কলেরা) রোগের দেবী এবং ময়াসুরের পত্নী। এককভাবে ওলাইচণ্ডীর পূজা ছাড়াও কোনও কোনও থানে সাতবোন বা নয়বোন নিয়ে ওলাবিবির পূজা প্রচলিত। এই সাত বোনের নাম হল ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, আজগাইবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি।[১]
কোনও কোনও আধুনিক গবেষকের মতে লৌকিক "সাতবিবি" ধারণাটি হিন্দু সপ্তমাতৃকা (ব্রহ্মাণী বা ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী বা ঐন্দ্রী, কৌমারী, বারাহী ও চামুণ্ডা) ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। তবে উক্ত সপ্তমাতৃকার সঙ্গে সাতবিবির কোনও সাদৃশ্য নেই বললেই চলে। ভারতে প্রাগার্য যুগ থেকেই যে সাত দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন মহেঞ্জোদাড়ো শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে পাওয়া যায়। এই সিলমোহরটিতে সাতজন নারীকে একসঙ্গে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা গিয়েছে।
ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত।[২][৩][৪]
নামকরণ
সম্পাদনাগোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, ওলাইচণ্ডী দেবীর আদি নাম ওলাউঠা-চণ্ডী বা ওলাউঠা-বিবি।[৫] বিসূচিকা বা কলেরা রোগের অপর নাম "ওলাউঠা " বা "ওলাওঠা" শব্দটি দু’টি প্রচলিত গ্রাম্য শব্দের সমষ্টি — "ওলা" ও "উঠা" বা "ওঠা"। "ওলা" শব্দের অর্থ নামা বা পায়খানা হওয়া এবং "উঠা" বা "ওঠা" শব্দের অর্থ উঠে যাওয়া বা বমি হওয়া। সেই থেকেই এই দেবী হিন্দুদের কাছে ওলাইচণ্ডী ও মুসলমানদের কাছে ওলাবিবি নামে পরিচিত।[৬][৭]
দেবী
সম্পাদনালোক বিশ্বাস অনুসারে, ওলাইচণ্ডী ময়াসুরের পত্নী। ময়াসুর হিন্দু পুরাণের অসুর, দানব, রাক্ষস ও দৈত্যদের রাজা ও স্থপতি।[২] ভক্তেরা তাঁকে কলেরার হাত থেকে ত্রাণকর্ত্রী দেবী মনে করেন। রোগ ও মহামারীতে আক্রান্ত অঞ্চলে তাঁর পূজা হয়।[২] এই নামটি এসেছে বিবির গান আখ্যান থেকে। এই আখ্যান অনুসারে, তিনি এক কুমারী মুসলমান রাজকন্যার সন্তান। তিনি অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরে দেবী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ ছিল তাঁর দাদামশাইয়ের (‘বাদশা’) ও রাজ্যের মন্ত্রীদের সন্তানদের আরোগ্য দান।[৪]
মূর্তি
সম্পাদনাওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির মূর্তি প্রধানত দুই প্রকারের। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এই দেবীর রূপ লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অনুরূপ। তাঁর গায়ের রং হলুদ/সবুজ, মুখ সুন্দর, দ্বিনয়না বা ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিনয়না, এলোকেশী অথবা মুকুট-পরিহিতা, বিভিন্ন অলংকারে সুসজ্জিতা, পরনে শাড়ি ও দণ্ডায়মান। কোথাও কোথাও দেবী ষষ্ঠীর ন্যায় কোলে শিশু-সহ উপবিষ্ট দেবীমূর্তিও দেখা যায়। কোনও কোনও স্থানে বাহন হিসেবে ঘোড়া দেখা যায়।সম্প্রসারিত দুই হাতে কোনও বিশেষ মুদ্রাও প্রদর্শিত হয় না।[২][৮] মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে দেবীমূর্তির পরিধানে থাকে পিরান ও পাজামা, মাথায় টুপি ও পায়ে নাগরা জুতো। সেক্ষেত্রেও দেবীকে বিভিন্ন অলংকারে সজ্জিতা হিসেবে দেখা যায় এবং তাঁর হাতে থাকে আসাদণ্ড।[৯]
পূজা
সম্পাদনাহিন্দুপ্রধান অঞ্চলে শনি-মঙ্গলবারেই ওলাইচণ্ডীর বিশেষ পূজা হয়ে থাকে। অন্যান্য অঞ্চলে ওলাবিবির পূজা হয় শুক্রবারে। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে ওলাইচণ্ডীর পূজায় চণ্ডী দেবীর পূজার মন্ত্র বা আচার পালিত হয় না। পূজায় বিশেষ কোনও মন্ত্রও নেই। নারী, এমনকি হাড়ি, ডোম প্রভৃতি নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরাও তাঁর পূজায় পৌরোহিত্যের অধিকারী। শনি-মঙ্গলবারে দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। তবে কোথাও কোথাও ছাগবলিও দেওয়া হয়। নদিয়ার ডোম নারীরা পশুবলি দিয়ে ওলাইচণ্ডীর পূজা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেশ, পান-সুপারি, বাতাসা, আতপ চাল, পাটালি ইত্যাদি শুকনো নৈবেদ্যে পূজা হলেও বাৎসরিক পূজা বা বিশেষ পূজায় অন্নভোগ প্রদানের রীতিও রয়েছে। ওলাবিবি যেখানে সাতবোনের সঙ্গে অবস্থান করেন, সেই মন্দিরগুলিকে বলা হয় সাতবিবির থান। এই থানগুলিতে পৌরোহিত্য করেন মুসলমান ফকিরেরা। সাত বনদেবীর পূজাচারের সঙ্গে সাতবিবির পূজার মিল লক্ষিত হয়। এই সাত দেবী বা সাত বোনের মধ্যে ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবিই প্রধান। এঁদের মাহাত্ম্যপ্রচারের জন্য মধ্যযুগে বেশ কিছু গান রচিত হয়েছিল, যেগুলি সাতবিবির গান নামে পরিচিত।[১০]
লোকায়ত বিধান
সম্পাদনাদেবীর বিশেষপল্লীগত পূজা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে কলেরা প্রসঙ্গ না থেকে প্রথাগত ও পারম্পরিক ভাবে পল্লীতে শনিবার বা মঙ্গলবার একত্র হয়ে পূজার আয়োজন করা হয়।
- মাঙ্গন করা - পল্লীর প্রধান গলায় বদির মালা অর্থাৎ খড়ের হার পরে দাঁতে তৃণধারণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পূজার জন্য অর্থ চাল ডাল ফলমূল ভিক্ষা করে।
- ছলন / সলন - এই পূজায় দেবীর ক্ষুদ্রাকৃতি মূর্তি বানিয়ে পূজা স্থানে রেখে দেওয়া হয়।
মন্দির
সম্পাদনাওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির উৎপত্তি সম্ভবত অধুনা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা অঞ্চলে। পরবর্তীকালে তাঁর পূজা একে একে কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম ও নদিয়া জেলায় প্রসারলাভ করেছিল। প্রথম দিকে গাছতলা, বনাঞ্চল ও জলাশয়ের ধারে অবস্থিত থানে তাঁর পূজা প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীকালে ওলাইচণ্ডীর মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। কলকাতা ও হাওড়া শহরে ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবিরর বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে: এগুলির কোনও কোনওটি অন্য কোনও দেবতা মন্দির, যেখানে ওলাইচণ্ডীও পূজিত হন; আবার কোনওটি ওলাইচণ্ডীরই মন্দির যেখানে অন্য দেবতাদেরও পূজা করা হয়। হাওড়া শহরের একটি রাস্তার নামও ওলাইচণ্ডী লেন। এই রাস্তাতেই হাওড়ার বিখ্যাত হাজার-হাত কালীমন্দির অবস্থিত। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্ট্রিটের শীতলা মন্দিরে, বাঞ্চারাম অক্রূর লেনের বাঁকারায় ধর্মঠাকুর মন্দিরে ও বেলগাছিয়া রোডের ওলাইচণ্ডী মন্দিরে অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গে ওলাইচণ্ডীও পূজিতা হন। কলকাতার উপকণ্ঠে গড়িয়া অঞ্চলের বৈষ্ণবঘাটায় ওলাবিবির একটি মন্দির রয়েছে। স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অধিবাসীরাই মন্দিরটি পরিচালনা করেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জয়নগরের কাছে রক্তাখাঁ গ্রামে ওলাবিবির একটি মন্দিরে দেবী বিবিমা নামে পূজিতা হন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় রাজকোট দুর্গে অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে ওলাইচণ্ডীরও পূজা হয়। বীরভূমে বোলপুর নীলকুঠির পাশেও ওলাইচণ্ডীর একটি মন্দির রয়েছে।[১১]
বেলগাছিয়া ওলাইচণ্ডী মন্দির
সম্পাদনাউত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে পরেশনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে ওলাইচণ্ডীর একটি সুবৃহৎ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে ষষ্ঠী, শীতলা ও মনসার সঙ্গে ওলাইচণ্ডীকেও পূজা করা হয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে তৎকালীন পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবী এই মন্দিরে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি স্থাপন করেছিলেন। তার আগে এখানে একটি পঞ্চানন মন্দির ছিল বলে জানা যায়। কথিত আছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির জনৈক কুঠিয়ালের স্ত্রী শ্রীমতী ডনকিং কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওলাইচণ্ডী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ডনকিং এক মুসলমান আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে সেই পঞ্চানন মন্দিরে এসে পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবীকে স্বপ্নের কথা জানালে ব্রহ্মময়ী দেবীই নিকটবর্তী একটি ঝিল থেকে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি মাথায় করে নিয়ে এসে মন্দিরে স্থাপন করেন।[১২]
বর্তমানে এই মন্দিরে একটি উঁচু বেদিতে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী ও ওলাইচণ্ডীর পিতলের মূর্তি পূজিত হয়। মূর্তিগুলির উচ্চতা ২ ফুট। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় দুই বার শুকনো ভোগ নিবেদন করা হয়। চৈত্রমাসে শীতলা পূজা ও অক্ষয়তৃতীয়া এই মন্দিরের দুই বাৎসরিক উৎসব। সেই সময় বহু ভক্তের সমাগম হয় মন্দিরে। এই উৎসবেই শুধুমাত্র অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। ওলাইচণ্ডীর পূজা হয় চণ্ডীর ধ্যান ও মন্ত্রে। বলিদানের প্রথা না থাকলেও মানতপূরণের বলি হয়ে থাকে। এমনকি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাও এখানে মানত বলি দিতে আসেন।[১৩]
সামাজিক প্রভাব
সম্পাদনাওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, তিনি হিন্দু দিব্য জননী ধারণার সঙ্গে একেশ্বরবাদী ইসলামিক আল্লাহ্-ধারণার মিশ্রণ।[৩] সম্ভবত ১৯শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরার দেবী রূপে ওলাইচণ্ডীর পূজা শুরু হয়।[১৪] ওলাইচণ্ডীর গুরুত্ব সাম্প্রদায়িক ও বর্ণব্যবস্থার সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।[২] যদিও আধুনিক যুগে কলেরার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়ে পড়ায় ওলাইচণ্ডীর পূজাও সীমিত হয়ে এসেছে।[২]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ২৬
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ পরেশচন্দ্র মন্ডল (২০১২)। "ওলাদেবী"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ক খ Islam in Bangladesh
- ↑ ক খ Ralph W. Nicholas. Fruits of Worship: Practical Religion in Bengal. Page 205. Orient Longman, 2003. আইএসবিএন ৮১-৮০২৮-০০৬-৩
- ↑ গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, বাংলার লৌকিক দেবতা, পৃ. ২৫
- ↑ গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, বাংলার লৌকিক দেবতা, পৃ. ২৫
- ↑ ড. দেবব্রত নস্কর, বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি, পৃ. ২৩৬
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ২৫
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ২৫
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ২৫-২৭
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ২৬-২৭
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ৩৫
- ↑ গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, পৃ. ৩৬
- ↑ "The Cool Goddess"। ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৫।
উল্লেখপঞ্জি
সম্পাদনা- গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, বাংলার লৌকিক দেবতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, এপ্রিল ১৯৭৮ সংস্করণ।
- গৌতম বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী: নানা রূপে নানা স্থানে, গিরিজা লাইব্রেরি, কলকাতা, ২০১২ সংস্করণ।
- ড. দেবব্রত নস্কর, বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৮ সংস্করণ