আবদুল মুজাফর নাসিরুদ্দিন সিকান্দর ঝা, বাদশা-ই-আবদুল কাইজার-ই-জামান, সুলতান-ই-আলম ওয়াজিদ আলি শাহ বাদশা[], সংক্ষেপে—ওয়াজিদ আলি শা[] (উর্দু: واجد علی شاہ‎‎), (৩০ জুলাই ১৮২২ – ১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭) ছিলেন আওধের নবাব। তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।[][]

ওয়াজেদ আলি শাহ
মীর্জা (রাজকীয় খেতাব)
আওধের বাদশাহ
আওধের ৫ম বাদশাহ
রাজত্ব১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬
পূর্বসূরিআমজাদ আলি শাহ
উত্তরসূরিবিরজিস কদর
জন্ম(১৮২২-০৭-৩০)৩০ জুলাই ১৮২২
লখনৌ, ভারত
মৃত্যু২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭(1887-09-21) (বয়স ৬৫)
মেটিয়াবুরুজ (গার্ডেনরিচ), কলকাতা, ভারত
পূর্ণ নাম
আবুল মনসুর মীর্জা মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলি শাহ
রাজবংশনিশাপুরি
পিতাআমজাদ আলি শাহ
ধর্মইসলাম
ওয়াজেদ আলি শাহর রৌপ্য মুদ্রা। মুদ্রার বিপরীত দিকে আওধের প্রতীক দৃশ্যমান।

১৮৫৬ সালে তার রাজ্য ব্রিটিশরা অধিকার করে নেয়। এরপর তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত হন। বাকি জীবন তিনি পেনশন নিয়ে অতিবাহিত করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন কবি এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

নির্বাসন কাল (১৮৫৬–১৮৮৭)

সম্পাদনা

ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। তৎকালীন মেটিয়াবুরুজে (বর্তমান গার্ডেনরিচ) তাঁর নির্বাসনের কাল অতিবাহিত করেন।

যাত্রার প্রস্তুতিপর্বের কিছু বিবরণ আছে এলু জানের কাহিনীতে। এলু জান ছেলেবেলা থেকেই নবাব পরিবারের হারেমের বাসিন্দা।[] সে ছিল নবাব আমজাদ আলির প্রধান বেগম, ওয়াজিদ আলির মা বেগম আউলিয়ার পরিচারিকা।[] বেগমের হুঁকো সাজাত সে, পায়ে তেল মাখিয়ে দিত।[] ফলে হারেম এবং দরবারের অনেক ঘটনার সে প্রত্যক্ষদর্শী। বেগম তার বিয়েও দিয়েছিলেন একটি যুবকের সঙ্গে।[] তার একটি ছোট্ট দোকান ছিল।[] ওয়াজিদ আলি এবং তাঁর জননীর সঙ্গে ওরা কলকাতায়ও এসেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ফিরে যায় লক্ষ্ণৌয়।[] সেখানে জোহানেস নামে এক বিদেশি সওদাগরের বাড়িতে কাজ নেয়।[] তারপর আর একজনের কাছে। তিনি সংকলন করেছিলেন এলু জানের কাহিনী।[] সেই বিদেশীকে এলু জান বলে—[]

বেগম, অর্থাৎ ওয়াজেদ আলির মা সেদিন স্নানের পর প্রসাধন করছিলেন। এমন সময় একটি সিল-করা বড় খাম আনা হলো তাঁর কাছে। বলা হল—জরুরি চিঠি। উজির এটি পাঠিয়েছেন। বেগম চিঠিখানি খুলে পড়তে লাগলেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি ‘রাজ্য শেষ হয়ে গেল’ বলতে বলতে পায়ে জুতো না পরেই ছুটলেন। উঠোনের পর দৌলতখানা। তারপরই নবাবের মহল। বেগম সেদিকে ছুটলেন। আমরা কেউ তাঁর চাদর, কেউ ওড়না, কেউ ছাতা, কেউ জুতো নিয়ে ছুটলাম তাঁর পিছু পিছু। আমরা এক একজন তাঁকে এক একটা পরাতে যাই আর তিনি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন—না, না, আমাকে পরিচারিকা ছাড়াই চলতে হবে। এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে যখন সিংহাসন ছাড়া চলতে হবে তখন হয়তো আমার ঘরও থাকবে না, খাওয়াও জুটবে না। বেগমের চোখে জল। আমরাও কাঁদতে লাগলাম।
বেগম কোনও খবর না পাঠিয়ে কোনও আচার-অনুষ্ঠান পালন না-করেই সোজাসুজি ঢুকে গেলেন সেই ঘরে যেখানে তাঁর ছেলে বসে আছেন। কেউ তাঁকে বাধা দিল না। সবাই সরে গিয়ে তাঁকে পথ করে দিল। সবাই নিস্তব্ধ। সবাই হতভম্ব।
‘বাদশা’ একা বসেছিলেন। তিনিও কাঁদছিলেন। মাকে দেখে তিনি দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। বেগম তিনবার সেলাম করে তাঁর সামনে গিয়ে বললেন—কি, এবার তোমার শখ মিটল তো? শেষ পর্যন্ত তোমার নাচ গান এবং বাজনার প্রতিদান পেলে তো? তোমাকে কি আমি বলিনি যে এই নিয়তিই অপেক্ষা করে আছে? তোমার পূর্বপুরুষরা কি কেউ কখনও জেনানার সাজে নেচেছেন? ‘বাদশা’ জবাবের একটা কথাও বললেন না।

এলু জান বলছে—[]

রাজ্যের বড় বড় লোকেরা এসে ‘বাদশা’কে বললেন—আমরা সৈন্য দিচ্ছি, গোলাবারুদ দিচ্ছি, ইংরাজের সঙ্গে লড়ে যান। বিদ্রোহ করুন। ‘বাদশা’ রাজি হলেন না। তাঁরা বেগমের কাছেও এলেন। তিনি প্রস্তাবটা ভেবে দেখবার জন্য এক রাত্তির সময় চাইলেন। বাহারান্নিসা নামে তাঁর একজন প্রিয় পরিচারিকা ছিল। বেগম তার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। পরদিন লড়াইয়ের প্রস্তাব তিনিও নাকচ করে দিলেন। সেদিনই তিনি আমাদের কাছে ইংল্যান্ড যাত্রার সংকল্পের কথা ঘোষণা করলেন। বললেন—আমি ইংরাজ-রানির কাছে যাব। তাঁরও পুত্রসন্তান রয়েছে, বেগম বললেন—তাঁকে আমি বলব আমার ছেলের মাথা থেকে তাজ কেড়ে না নিতে। তাঁর কি মুকুট নেই, রাজত্ব নেই, যথেষ্ট ধন-দৌলত নেই? সারা দুনিয়াই কি তাঁর চাই? আমরা বললাম—কি করে আপনি যাবেন? আপনি নদী দেখলেই ভয় পান, সীমাহীন সমুদ্র, বিশাল কালাপানি পার হবেন কেমন করে? কিন্তু তিনি কিছুতেই আমাদের কথা শুনতে রাজি হলেন না। বেগম যাত্রার জন্য তৈরি হতে লাগলেন।

সেই প্রস্তুতির কিছু বিবরণ দিয়েছে এলু জান। হারেমে একটা বিরাট চৌবাচ্চা ছিল। সেটার জল ফেলে দিয়ে তার তলায় মাটির নীচে তৈরি হল এক চোরাকুঠরি। বেগম তার মধ্যে সোনা রুপোর আসবাবপত্র, এবং যেসব গয়নাগাটি তিনি ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবেন বলে স্থির করেছেন সেগুলো বাদ দিয়ে সব মণিমুক্তো তার মধ্যে জড়ো করলেন। তারপর মাদুর, অয়েলক্লথ, এ সব ঢেকে তার উপর গড়ে তোলা হল ছাদ। ছাদের উপর তেমনই রইল চৌবাচ্চা। তাতে জল ভরা হল। বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না তার তলায় কি রয়েছে।[]

এলু জান বলছে—[]

প্রস্তুতি শেষ। বেগম তৈরি হলেন ইংল্যান্ড যাত্রার জন্য। বেগমের সঙ্গে রইল বাহারান্নিসা, আমি এবং আর কয়েকজন পরিচারিকা। হারেমের অন্যদের অনেককে ছাড়িয়ে দেওয়া হল। কারও কারও জন্য ব্যবস্থা হল পেনসনের। বেগম যাত্রাপথের জন্য প্রচুর পানীয় জল নিলেন তাঁর সঙ্গে।

১৮৫৭এর মহাবিদ্রোহের সময় আচমকা বন্দি করা হল তাঁকে। ‘হুতোম’ লিখছেন—“লক্ষ্ণৌর বাদশাকে কেল্লায় পোরা হলো, গোরারা সময় পেয়ে দু’চার বড় ঘরে লুটতরাজ আরম্ভ কল্লে মার্শাল লা জারি হল।” ‘সম্বাদ ভাস্কর’ জানাল—“অযোধ্যার বাদশাহ ফোর্ট উইলম দুর্গ মধ্যে কোর্ট মার্সাল বিচারে আসিয়াছেন।” (১৮ জুন, ১৮৫৭) তারপর পদ্যে খেদোক্তি—

কোথা গেল সিংহাসন কোথা রাজ্যধন।
কোথায় অবশেষে ভাগ্যে ছিল বন্ধন॥

সাহিত্য চর্চা ও পৃষ্ঠপোষক

সম্পাদনা

কেউ কেউ তাকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেছেন। তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তার রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি। ১৮৬১ থেকে মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ হয়েছে, সেখানে তা আরও পরিণত।

যন্ত্রসংগীত

সম্পাদনা

মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও তুলনাহীন। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় ওয়াজিদ লিখেছেন, তিনি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। সেনি ঘরানার উস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তারই আনা, ওয়াজিদ এই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করেন। ছিলেন বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান। ওয়াজিদের আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। এই দরবারেই নাকি উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজিদ আলির কাছে ছিলেন। ওয়াজিদ তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেন। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তার নাম।

কলকাতায় ঐতিহ্যে নবাব

সম্পাদনা

সুদীপ্ত মিত্র সবিস্তারে দেখিয়েছেন, কলকাতার আরও অনেক ঐতিহ্যের সূচনাই মেটিয়াবুরুজে। আলিপুর চিড়িয়াখানার জন্ম ১৮৭৬-এ, তার অনেক আগেই নিজস্ব বিশাল চিড়িয়াখানা তৈরি করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে জীবজন্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র ছিল ঈর্ষণীয়। ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তার হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। লখনউ পানের কদর আজও কম নয়। []

গ্যালারি

সম্পাদনা
পূর্বসূরী
আমজাদ আলি শাহ
পাদশাহ-ই-আওধ, শাহ-ই-জামান
১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭ – ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬
উত্তরসূরী
বিরজিস কদর

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. শ্রীপান্থ (২০১৮) [২৪ আগস্ট ১৯৯০]। মেটিয়াবুরুজের নবাব। ৪৫, বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৭০০০০৯: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। আইএসবিএন 978-81-7066-300-3 
  2. "Wajid-Ali-Shah (1847-1856)"। National Informatics Centre, India। ১১ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  3. "Wajid Ali Shah (1847-1856)"। Lucknow.me। সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ 
  4. "বিরিয়ানি থেকে সরোদ" 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা