ওমর আল-মুখতার
ওমর আল-মুখতার (আরবি: عمر المختار) (২০ আগস্ট ১৮৫৮[৩][৪]–১৬ সেপ্টেম্বর,১৯৩১) বা মরুর সিংহ এবং উপনিবেশিক ইতালীয়দের মধ্যে মনিফার মাতারি নামে পরিচিত[৫], লিবিয়ার সিরেনিকায় জানযুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[৬] ১৯১২ সাল থেকে শুরু করে প্রায় বিশ বছর তিনি লিবিয়ায় ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ১৯৩১ সালে তিনি ইতালীয়দের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
ওমর আল-মুখতার عُمَر الْمُخْتَار | |
---|---|
জাওয়ায়াত আইন কালকের শাসক | |
কাজের মেয়াদ ১৮৯৭–১৯০৩ | |
উত্তরসূরী | পদ বিলুপ্তি |
জাওয়ায়াত লাকসুরের শাসক | |
কাজের মেয়াদ ১৯০২–১৯১১[১] | |
উত্তরসূরী | পদ বিলুপ্তি |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | জানযুর, সিরেনিকা | ২০ আগস্ট ১৮৫৮
মৃত্যু | ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সুলুক, ইতালি অধীকৃত লিবিয়া | (বয়স ৭৩)
সমাধিস্থল | সুলুক, লিবিয়া |
জাতীয়তা | লিবিয়ান |
পিতামাতা | আল মুখতার ইবনে মুহাম্মদ (পিতা) আয়িশা বিনতে মুহারিব (মাতা) |
পেশা | সেনুসি শাসক যাওয়ায়িস |
যে জন্য পরিচিত | লিবিয়ায় ইতালির উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন |
ধর্ম | ইসলাম |
ধর্ম | ইসলাম (সুন্নী) শাখা: আশআরী মাযহাব: মালিকি [২] |
স্বাক্ষর | |
সামরিক পরিষেবা | |
ডাকনাম | শায়েখ আল-শহীদ’ شَيخ الشُّهَدَاء,শহীদের শায়েখ |
আনুগত্য | সেনসুরি |
শাখা | সেনুসিদ মিলিটারি |
যুদ্ধ | ফরাসিদের চাদ উপনিবেশ ইতালি–তুর্কি যুদ্ধ সেনিসিদ–ব্রিটিশ যুদ্ধ সেনিসিদ–ইতালি যুদ্ধ |
জীবন
সম্পাদনাওমর আল-মুখতার পূর্ব সিরনিকার আল-বুতনান জেলায় জানযুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি পিতৃমাতৃহীন হন। স্থানীয় মসজিদে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। সেনুসি আন্দোলনের মূলকেন্দ্র জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৮ বছর শিক্ষালাভ করেন। ১৮৯৯ সালে চাদে ফরাসীদের প্রতিহত করার জন্য রাবিহ আযযুবায়েরের সাহায্যার্থে অন্য সেনুসিদের সাথে তাকে চাদে পাঠানো হয়।
ইতালীয় আক্রমণ
সম্পাদনা১৯১১ সালে ইতালী-তুর্কী যুদ্ধের সময় অ্যাডমিরাল লুইগি ফারাভেলির নেতৃত্বে ইতালীয় নৌবাহিনীর একটি দল লিবিয়ার উপকূলে পৌছায় যা তৎকালে উসমানীয় তুর্কীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তুর্কী প্রশাসন ও সেনাদেরকে তাদের অধীনস্থ অঞ্চল ইতালীয়দের কাছে ছেড়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু তুর্কী ও তাদের লিবিয় মিত্ররা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে লিবিয়ার অভ্যন্তরে চলে যায়। ইতালীয়রা তিন দিন পর্যন্ত শহরে গোলাবর্ষণ করে। এরপর অধিকৃত অঞ্চলকে ইতালীর অধীনস্থ বলে ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনা ইতালীয় ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী এবং ওমর আল-মুখতারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা করে।[৭]
গেরিলা যুদ্ধ
সম্পাদনাপেশাগত দিক থেকে কুরআন শিক্ষক হলেও মুখতার মরুভূমিতে যুদ্ধকৌশল বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। তার এই জ্ঞানকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইতালীয়দের বিরুদ্ধে কাজে লাগান। এই ইতালীয়রা মরু অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল না। মুখতার তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে সফল গেরিলা আক্রমণে সক্ষম হন। আক্রমণের পর তার বাহিনী মরুভূমিতে আত্মগোপন করত। তার বাহিনী দক্ষতার সাথে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, সৈন্যবহরের উপর আক্রমণ চালায় এবং যোগাযোগ ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তার গেরিলা পদ্ধতির লড়াইয়ে ইতালীয় সৈনিকরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।[৮]
ইতালীয় গভর্নর আর্নেস্ট বমবেলি ১৯২৪ সালে জেবেল আখদারের পার্বত্য অঞ্চলে পাল্টা গেরিলা বাহিনী গঠন করেন যা বিদ্রোহীদের উপর বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করে। মুখতার দ্রুত তার কৌশল পাল্টান এবং মিশর থেকে সাহায্য লাভে সমর্থ হন। ১৯২৭ সালের মার্চে ইতালীয়রা জাঘবুব দখল করে। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত মুখতার সানুসি বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। তার দক্ষতার কারণে ইতালীয় গভর্নর জেনারেল আটিলিয়ো তেরুজ্জি ওমরকে “ব্যতিক্রমী স্থিরচিত্ত ও অটল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন” বলে উল্লেখ করেন।
১৯২৯ সালে পিয়েত্রো বাদোগলি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। ওমর আল-মুখতারের সাথে আলোচনায় তাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। সেই বছরের অক্টোবরে মুখতার এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং ইতালীয় সেনানায়ক রডোলফো গ্রাজিয়ানির সাথে ব্যাপক যুদ্ধের জন্য লিবিয় যোদ্ধাদের পুনরায় সংগঠিত করেন।
জুনে পরিচালিত সেনা অভিযানে গ্রাজিয়ানির বাহিনী মুখতারের কাছে পরাজিত হয়। পিয়েত্রো বাদোগলি, এমিলো দা বোনো ও বেনিতো মুসোলিনির সাথে গ্রাজিয়ানি মুখতারের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সহস্রাধিক মানুষকে উপকূলবর্তী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়, গিয়ারাবুবে উপকূল থেকে লিবিয়া ও মিশরের সীমানা বন্ধ করে দেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে যোদ্ধারা কোনো বিদেশী সাহায্য না পায় এবং স্থানীয় জনতার সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। সানুসিদের প্রতিরোধে গ্রাজিয়ানির এই পরিকল্পনা সফল হয়। বিদ্রোহীরা সাহায্যবঞ্চিত হয় এবং ইতালীয় বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। স্থানীয় চর ও সহায়তাকারীদের সাহায্যে ইতালীয় বাহিনী স্থলযুদ্ধেও বিদ্রোহীদের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। ঝুকি সত্ত্বেও মুখতার লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাকে অতর্কিত আক্রমণ করে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুখতারের চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ, জেনারেল রডোলফো গ্রাজিয়ানির বর্ণনামতে : “মাঝারি উচ্চতা, সুঠাম, সাদা দাড়ি গোঁঁফ বিশিষ্ট ব্যক্তি। ওমর আল-মুখতার ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন, ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী, শক্তিসম্পন্ন ও ক্ষীপ্র ব্যক্তি, নিঃস্বার্থ ও আপোষহীন। তিনি খুব ধার্মিক ও দরিদ্র ছিলেন যদিও তিনি ছিলেন সেনুসিদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে।”
মৃত্যুদন্ড
সম্পাদনাইতালীয় ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে মুখতারের প্রায় ২০ বছরব্যাপী লড়াই ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সমাপ্তি লাভ করে। স্লোনটার নিকটে যুদ্ধে তিনি আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। তাকে গ্রেপ্তারে সাহায্য করায় স্থানীয় নেতাদেরকে পুরষ্কৃত করা হয়। তার দৃঢ়তা জেলারের উপর প্রভাব ফেলে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]মুখতারের জিজ্ঞাসাবাদকারীদের মতে তিনি কুরআন শরীফের আয়াত তেলাওয়াত করতেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মাত্র তিন দিনের মধ্যেই মুখতারের বিচার সম্পন্ন হয়। বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৪ সেপ্টেম্বর রায়ে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এই বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল না। শেষ কথা জানতে চাওয়া হলে মুখতার কুরআনের আয়াত “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন” (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাব) পাঠ করেন। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সুলুকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তার অনুসারীদের সামনে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল সত্তর বছর।
চলচ্চিত্র
সম্পাদনাওমর আল-মুখতারের জীবনের শেষ দিনগুলো "লায়ন অব দ্য ডেজার্ট"(১৯৮১) চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। ওমর আল-মুখতার ও রডোলফো গ্রাজিয়ানির মধ্যকার লড়াইকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। এতে অ্যান্থনি কুইন, অলিভার রিড ও আইরিন পাপাস অভিনয় করেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ al-Sanusiya pg.271
- ↑ as Salab, Ali Muhammad (২০১১)। Omar Al Mokhtar Lion of the Desert (The Biography of Shaikh Omar Al Mukhtar)। Al-Firdous। পৃষ্ঠা 1। আইএসবিএন 978-1874263647।
- ↑ Profile of Omar Al-Mukhtar[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "Archived copy"। ৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ Srinivas, Mysore Narasimhachar., (১৯৯৬)। Social structure and change। Shah, A. M., 1931-, Baviskar, B. S. (Baburao Shravan), 1931-, Ramaswamy, E. A.। New Delhi: Sage Publications। আইএসবিএন 81-7036-494-9। ওসিএলসি 33898473।
- ↑ Mnifa is "a generic name for many groups of 'Clients of the Fee' (Marabtin al-sadqan)." These are client tribes having no sacred associations and are known as Marabtin al-sadqan because they pay sadaqa, a fee paid to a free tribe for protection. Peters, Emrys L. (1998) "Divine goodness: the concept of Baraka as used by the Bedouin of Cyrenaica", page 104, In Shah, A. M.; Baviskar, Baburao Shravan and Ramaswamy, E. A. (editors) (1998) Social Structure and Change: Religion and Kinship (Volume 5 of Social Structure and Change) Sage Publications, Thousand Oaks, California, আইএসবিএন ০-৭৬১৯-৯২৫৫-৩; Sage Publications, New Delhi, India, আইএসবিএন ৮১-৭০৩৬-৭১৩-১
- ↑ Encyclopedia of World Biography on Omar al-Mukhtar, BookRags.com
- ↑ Libya profile - Timeline, BBC News Africa, 1 November 2011