এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস

এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস একটি প্রাচীন মিশরীয় মেডিকেল পাঠ্য, এবং ট্রমার উপরে রচিত আজ অবধি জ্ঞাত প্রাচীনতম সার্জিকাল নিবন্ধ। ১৮৬২ সালে যিনি এই প্যাপিরাস ক্রয় করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে এ্রটির নামকরণ করা হয়েছে।[২] এই নথিটি সামরিক শল্য চিকিৎসার সারগ্রন্থ হতে পারে যা আঘাত, অস্থিভঙ্গ, ক্ষত, স্থানচ্যুতি এবং টিউমার সংক্রান্ত ৪৮ টি কেস বর্ণনা করে। [৩] এটির রচিত হয়েছিল প্রাচীন মিশরে দ্বিতীয় মধ্যবর্তী সময়কালের ষোড়শ-সপ্তদশ রাজবংশের শাসনামলে, আনু. ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।[৪] :৭০ এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস আজ অবধি টিকে থাকা চারটি প্রধান মেডিকেল প্যাপাইরির মধ্যে অনন্য একটি প্যাপিরাস।[৫] অন্যান্য প্যাপাইরি, যেমন- এবারস প্যাপিরাস এবং লন্ডন মেডিকেল প্যাপিরাস, জাদুবিদ্যা ভিত্তিক মেডিকেল পাঠ্য হলেও, এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস প্রাচীন মিশরের চিকিৎসা পদ্ধতির একটি যুক্তিসঙ্গত এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে,[৬]:৫৮ যেখানে চিকিৎসা এবং জাদুবিদ্যার মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। অসুস্থতার কেসগুলো রহস্যজনক হলে, যেমন- অভ্যন্তরীণ রোগের ক্ষেত্রে জাদুবিদ্যার প্রয়োগ আরও লক্ষণীয় হত।[৭]

নিউ ইয়র্ক একাডেমি অব মেডিসিনের বিরল গ্রন্থমালা কক্ষে এডুইন স্মিথ প্যাপিরাসের ষষ্ঠ এবং সপ্তম ফলক[১]

এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস ৪.৬৮ মিটার বা ১৫.৩ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি স্ক্রোল। এটির রেক্টোতে (সামনের পিঠে) সতেরটি কলামে ৩৭৭ টি লাইন, আর ভার্সোতে (উল্টো পিঠে) পাঁচটি কলামে ৯২ টি লাইন রয়েছে। স্ক্রোলটির টুকরা টুকরা বাইরের কলাম বাদে, প্যাপিরাসটির বাকি অংশ অক্ষত রয়েছে, যদিও বিশ শতকের কিছু সময়ে এটিকে পৃষ্ঠা প্রতি একটি কলাম হিসেবে কাটা হয়েছিল।[৪]:৭০ এটি কালো কালি ব্যবহার করে হায়রাটিক লিপিতে ডান-থেকে-বাম দিকে লেখা হয়েছে এবং সাথে লাল কালিতে ব্যাখ্যামূলক টীকা যোগ করা হয়েছে। প্যাপিরাসটির বেশিরভাগ অংশ ট্রমা এবং শল্যচিকিৎসা সংক্রান্ত হলেও, স্ত্রীরোগবিদ্যা এবং প্রসাধনীর উপরেও কিছু সংক্ষিপ্ত বিভাগ রয়েছে।[৭] সামনের পিঠে, আঘাতের ৪৮টি কেস রয়েছে। প্রতিটি কেসে আঘাতের ধরন, রোগীর পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় ও প্রোগনোসিস এবং চিকিৎসার বিশদ বিবরণ রয়েছে।[৮] :২৬–২৮ উল্টো পিঠে, আটটি জাদুমন্ত্র এবং পাঁচটি প্রেসক্রিপশন রয়েছে। উল্টো পিঠের মন্ত্রগুলো এবং ৮ ও ৯ নং কেস দুটি এই মেডিকেল পাঠ্যটির ব্যবহারিক প্রকৃতির ব্যতিক্রম। :৭০ সাধারণ মন্ত্র এবং জাদুমন্ত্রগুলো অন্তিম কেসসমূহে শেষ অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।[৭]

রচয়িতা সম্পাদনা

এডুইন স্মিথ প্যাপিরাসের রচয়িতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্যাপিরাসটির বেশিরভাগ অংশই এক জন লিপিকার লিখেছিলেন, কেবল কিছু ক্ষুদ্রাংশ আরেকজন লিপিকার অনুলিপি করেছিলেন।[৭] প্যাপিরাসটি কোনও রচয়িতার নাম উল্লেখ না করেই হঠাৎ একটি লাইনের মাঝখানে শেষ হয়ে গিয়েছে।[৪] :৭১ ধারণা করা হয় যে, প্যাপিরাসটি পুরাতন সাম্রাজ্যের কোন রেফারেন্স পাণ্ডুলিপির একটি অসম্পূর্ণ অনুলিপি, যা প্রাচীন ব্যাকরণ, পরিভাষা,[৭] রুপ এবং ভাষ্য দ্বারা প্রমাণিত। জেমস হেনরি ব্রেস্টেড অনুমান করেছিলেন- যদিও তিনি বলেই দিয়েছিলেন সেটি একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অনুমান যে- মূল লেখক হতে পারেন ইমহোটেপ, যিনি ৩,০০০-২,৫০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে একজন স্থপতি, মহাযাজক এবং পুরাতন সাম্রাজ্যের চিকিৎসক ছিলেন।[৯] :

পদ্ধতি সম্পাদনা

প্যাপিরাসটির যুক্তিসঙ্গত এবং ব্যবহারিক প্রকৃতি ৪৮ টি কেস হিস্ট্রিতে চিত্রিত করা হয়েছে, যা প্রতিটি অঙ্গ অনুসারে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[৫] উপস্থাপিত কেসগুলো স্বতন্ত্র নয়, সাধারণ।[২] প্যাপিরাসটি মাথার আঘাতের বর্ণনা থেকে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে ঘাড়ের, বাহুর এবং ধড়ের আঘাতের ট্রিটমেন্ট বিশদভাবে বর্ণনা করে।[৮] :২৯ এখানে অনেকটা আধুনিক শারীরস্থানিক ব্যাখ্যা উদঘাটনের মতোই [৭] শারীরস্থানিক অধ:ক্রম অনুসারে আঘাতের বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি কেসের শিরোনাম ট্রমার প্রকৃতির বিবরণ দেয়, যেমন- “তাঁর মাথার জখমের ক্ষেত্রে করণীয়, যা হাড়ে প্রবেশ করে মাথার খুলি ফাটিয়ে দিয়েছে”।[৪] :৭৪

চিকিত্সার মধ্যে হ'ল টিউমার (ঠোঁট, গলা এবং কাঁধের ক্ষতের জন্য) দিয়ে ক্ষত বন্ধ করা,[১০] ব্যান্ডেজিং, স্প্লিন্টস, পোল্টিস,[৭] মধুতে সংক্রমণ রোধ এবং নিরাময় এবং কাঁচা মাংস দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করা। [৪] :৭২ অস্থিরতা মাথা এবং মেরুদণ্ডের কর্ডের আঘাতের পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য নিম্ন ভাঙাগুলির জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। পেপাইরাস বাস্তবসম্মত শারীরবৃত্তীয়, শারীরবৃত্তীয় এবং প্যাথলজিকাল পর্যবেক্ষণগুলিও বর্ণনা করে। [১১] এটিতে ক্রেনিয়াল স্ট্রাকচার, মেনিনেজস, মস্তিষ্কের বাহ্যিক পৃষ্ঠ, সেরিব্রোস্পাইনাল তরল এবং ইন্ট্রাক্রানিয়াল পালসেশনের প্রথম পরিচিত বিবরণ রয়েছে। [২] : এই পেপাইরাসগুলির পদ্ধতিগুলি মিশরীয় ওষুধগুলির জ্ঞানের একটি স্তর দেখায় যা 1000 বছর পরে হিপোক্রেটিসের চেয়ে বেশি ছাপিয়ে যায়। [৬] :৫৯ দেহের বিভিন্ন অংশে মস্তিষ্কের আঘাতের প্রভাব স্বীকৃত, যেমন পক্ষাঘাত। ক্রেনিয়াল আঘাতের স্থান এবং ক্ষতিগ্রস্থ শরীরের পাশের মধ্যে সম্পর্কও রেকর্ড করা হয়, যখন ভার্ভেট্রাইয়ের ক্রাশিংয়ের আঘাতগুলি মোটর এবং সংবেদনশীল ফাংশনগুলিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এর ব্যবহারিক প্রকৃতি এবং ট্রমা তদন্তের ধরনের কারণে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে প্যাপিরাস সামরিক লড়াইয়ের ফলে ট্রমাটির পাঠ্যপুস্তক হিসাবে কাজ করেছিল। :১১

ইতিহাস সম্পাদনা

এডুইন স্মিথ প্যাপিরাসটি দ্বিতীয় মধ্যবর্তী সময়কালের ১৬-২৫ তম রাজবংশের রাজত্বকালে সৃষ্ট। এই সময়ে মিশর থিবস থেকে শাসিত হত এবং সম্ভবত প্যাপিরাসটি সেখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল।[৪] :৭০–৭১ এডুইন স্মিথ, একজন আমেরিকান মিশরতাত্ত্বিক,[৫] ১৮২২ সালে কানেকটিকাটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন - একই বছরে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপিরও অর্থোদ্ধার করা হয়েছিল।[২] তিনি ১৮৬২ সালে মিশরের লুক্সর শহরে মুস্তাফা আগা নামের একজন মিশরীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্যাপিরাসটি কিনেছিলেন।[৮] :২৫

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্যাপিরাসটি স্মিথের কাছেই ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে নিউ-ইয়র্ক হিস্টরিকাল সোসাইটিতে প্যাপিরাসটি দান করে দেন। সেখানকার ক্যারোলিন র‍্যানসম উইলিয়ামস এটির গুরুত্ব জনস্মমুখে তুলে ধরেন। তিনি ১৯২০ সালে জেমস হেনরি ব্রেস্টেডকে "স্মিথ সম্ভারের মেডিকেল প্যাপিরাসটি" নিয়ে কাজ করার আশা ব্যক্ত করে একটি চিঠি লিখেছিলেন।[১২][১৩] ডাঃ আরনো বি লখার্টের মেডিকেল পরামর্শ নিয়ে হেনরি ব্রেস্টেড ১৯৩০ সালে প্যাপিরাসটির প্রথম অনুবাদ শেষ করেছিলেন।[৮] :২৬ সেসময় ব্রেস্টেডের অনুবাদটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রচলিত ধারণা পালটে দিয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে মিশরীয় স্বাস্থ্য সেবা কেবল মিশরীয় অন্যান্য মেডিকেল উত্সগুলো থেকে প্রাপ্ত ঐন্দ্রজালিক নিরাময় পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। গভীর পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে লব্ধ যুক্তিসঙ্গত এবং বৈজ্ঞানিক রীতিনীতিও ব্যবহৃত হত।[৯] :১২             

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Martin, Andrew J. (২০০৫-০৭-২৭)। "Academy Papyrus to be Exhibited at the Metropolitan Museum of Art" (সংবাদ বিজ্ঞপ্তি)। The New York Academy of Medicine। নভেম্বর ২৭, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৬-০৩ 
  2. Wilkins, Robert H. (১৯৯২)। Neurosurgical Classics (2nd সংস্করণ)। American Association of Neurological Surgeonsআইএসবিএন 978-1-879284-09-8এলসিসিএন 2011293270 
  3. Lawrence, Christopher (২০০৮)। "Surgery"Biomedicine And Health: Surgery। In Context। Galeআইএসবিএন 978-1-4144-0299-4এলসিসিএন 2007051972 
  4. Allen, James P. (২০০৫)। The Art of Medicine in Ancient Egypt। The Metropolitan Museum of Art/Yale University Pressআইএসবিএন 978-0-300-10728-9এলসিসিএন 2005016908 
  5. Lewkonia, Ray (২০০৬)। "education"। The Oxford Companion to Medicine (Online সংস্করণ)। Oxford Referenceআইএসবিএন 978-0-19-172745-0এলসিসিএন 2001021799 
  6. Ghalioungui, Paul (১৯৬৫)। Magic and Medical Science in Ancient Egypt Barnes & Nobleএলসিসিএন 65029851 
  7. The Oxford Encyclopedia of Ancient Egypt 
  8. Nunn, John F. (১৯৯৬)। Ancient Egyptian Medicine University of Oklahoma Pressআইএসবিএন 978-0-8061-2831-3এলসিসিএন 95039770 
  9. Breasted, James Henry (১৯৯১)। The Edwin Smith Surgical Papyrus: published in facsimile and hieroglyphic transliteration with translation and commentary in two volumesUniversity of Chicago Oriental Institute Publications, v. 3–4। University of Chicago Pressআইএসবিএন 978-0-918986-73-3এলসিসিএন 31007705 
  10. Sullivan, Richard (আগস্ট ১৯৯৬)। "The Identity and Work of the Ancient Egyptian Surgeon"Sage Publications: 467–73। ডিওআই:10.1177/014107689608900813পিএমআইডি 8795503পিএমসি 1295891  
  11. Zimmerman, Leo M.; Veith, Ilza (১৯৯৩)। Great Ideas in the History of Surgery। Jeremy Norman Publishing। আইএসবিএন 978-0-930405-53-3এলসিসিএন 93013671 
  12. Sheppard, Kathleen (ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬)। "The Contributions of Caroline Ransom Williams (1872-1952) to Archaeology"Brewminate 
  13. Randolph, Louise F. (১৯২১)। "College Women and Research": 51। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা