এজেন্ট ব্যাংকিং হল একজন খুচরা বিক্রেতা বা ডাক আউটলেট যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্যাংক সেবাগ্রহীতার লেনদেন নির্বাহ করে।ব্যংকের শাখার পরিবর্তে খুচরা আউটলেটের মালিক অথবা কর্মচারী লেনদেন নির্বাহ করে যা সেবাগ্রহীতা কে টাকা জমা করা, টাকা উত্তোলন, ফান্ড ট্রান্সফার, বিল পরিশোধ, হিসেব জানতে চাওয়া অথবা সরকারী সুবিধা গ্রহণ করা ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে থাকে। ব্যাংকের এজেন্ট হিসেবে থাকতে পারে ফার্মেসী, সুপারমার্কেট, লটারী আউটলেট, ডাকঘর ইত্যাদি।

বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান হারে এইসব খুচরা বিক্রেতা ও ডাকঘরগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বণ্টন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারিত হয়ে আসছে।উন্নত দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এজেন্ট ব্যাংকিং[১]

ব্যাংকের এজেন্টরা সাধারণত পয়েন্ট অব সেল(পিওএস) কার্ড রিডার, মোবাইল ফোন,বারকোড স্ক্যানার, পিন প্যাড ইত্যাদির সাহায্যে কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকে।মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও ব্যবহার করে যা পার্সোনাল ডায়াল আপ বা অন্য ডাটা কানেকশন ব্যবহার করে কম্পিউটারের সার্ভারের সাথে সংযুক্ত থাকে।সেবাগ্রহীতারা এজেন্টের কাছে লেনদেন করার জন্য ম্যাগনেটিক ব্যাংক কার্ড বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যথাক্রমে তার ব্যাংক অথবা ই-ওয়ালেটে প্রবেশ করার জন্য।সেবাগ্রহীতা সাধারণত পিন নাম্বার দিয়ে শনাক্ত হয়ে থাকে তবে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমেও এটা করা যায়।লেনদেন যাচাইকরণ, অনুমোদন ও অন্যান্য ফয়সালার ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিং অন্য যে কোন দূরবর্তী ব্যাংক চ্যানেলের মতই কাজ করে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুচরা আউটলেটের মাধ্যমে কাজ করতে পারবে কিনা তা স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নির্ধারণ করে দেয়।যদি কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয় এজেন্ট ব্যাংকের চুক্তি করতে তাহলে এটা কি ধরনের হবে, কী সেবা প্রধান করতে পারবে খুচরা আউটলেটগুলোতে, কীভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্যাশ পরিবহন করবে,ভোক্তা সংরক্ষণ ইত্যাদি নীতিমালা নিয়ন্ত্রণকারীদের দ্বারা নির্ধারণ করে দেয়।

এজেন্ট ব্যাংকিং এর স্বপক্ষে যুক্তি সম্পাদনা

এজেন্ট ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সেবাগ্রহীতাদেরকে ব্যস্ত শাখাগুলোর "পরিপূরক" এবং অনেকক্ষেত্রে সহজ মাধ্যমে সেবা দিয়ে থাকে।বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এজেন্টের সহায়তা নিয়ে থাকে "বাড়তি" গ্রাহক এলাকা বা দূরবর্তী অঞ্চলে পৌছানোর জন্য।গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রায় অসম্ভব কারণ লেনদেনের সংখ্যা এবং ভলিউমের পরিমাণ কম থাকায় শাখার খরচ নির্বাহ করা সম্ভব হয় না।এইরকম পরিবেশে এজেন্টদের ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক অবকাঠামোর উপর নির্ভর করে - এবং কম স্থাপন ও পরিচালন ব্যায়ে নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে প্রথমবারের মত বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদানের সুযোগ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও নিম্ন আয়ের মানুষেরা ব্যাংকের শাখায় গিয়ে লেনদেন করার চেয়ে স্থানীয় দোকান থেকেই ব্যাংকিং কাজ সেরে নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

ব্যাংকের এজেন্টরা হলো মোবাইল ব্যাংকিং এর মেরুদন্ড, যেমন, মোবাইল ফোনের সাহায্য লেনদেন নির্বাহ করা।কোন সেবাগ্রহীতাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের ইলেকট্রনিক টাকা কে ক্যাশে রূপান্তর বা এর বিপরীত টা করতে চাইলে ব্যাংকের কোন শাখা, এটিএম বুথ অথবা এজেন্টের কাছ থেকে করতে হবে।বিশেষ করে গ্রামীণ দূরবর্তী এলাকায় যেখানে ক্যাশ, লেনদেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়,গ্রাহকদেরকে কার্যকারী সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ব্যাংকিং এর উপর নির্ভরশীল।

এজেন্ট ব্যাংকিং এর সুবিধাসমূহ
সেবাগ্রহীতার জন্য
কম লেনদেন খরচ(সেবাগ্রহীতার বাড়ির কাছেরই কোন মুদি দোকান, ইন্টারনেট সেবাদাতার দোকান ইত্যাদি থেকেই লেনদেন কাজ করতে পারে।);লম্বা সময় পর্যন্ত খোলা থাকে, শাখা থেকে ভীড় কম বলে লাইনে দাড়াতে হয় না,দরিদ্র এবং অশিক্ষিত মানুষ যারা ব্যাংকের শাখায় যেতে চায় না তারা সহজেই লেনদেন করতে পারে।
এজেন্ট এর জন্য
বেশি মানুষ দোকানে আসার ফলে দোকানের বিক্রি বাড়ে,সুপরিচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকার ফলে ব্যাবসার সুনাম বাড়ে,কমিশন এবং অন্যান্য সুবিধা থেকে বাড়তি আয় হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য
গ্রাহকের সংখ্যা এবং বাজার আধিপত্য বৃদ্ধি পায়,যে এলাকায় লেনদেন সংখ্যা এবং পরিমাণ কম সেখানেও কম খরচের মধ্যে সেবা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়,বাড়তি বিনোয়গ এবং মুনাফা থেকে অতিরিক্ত আয় হয়,শাখাগুলোর কাজের চাপ কম হওয়ার কারণে সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পাদনা

সেবাগ্রহীতার ক্ষেত্রে তার ব্যাংক হিসেব চালানোর জন্য ব্যাংকের শাখায় যাওয়া,এজেন্ট কাছে যাওয়া বা এটিএম বুথে যাওয়ার মধ্যে কোন পার্থ্যক্য নেই।এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি তার ব্যাংকে একটি হিসেব খুলতে হয়।এর সাথে এজেন্টকে তার ঐ হিসেবের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখতে হয় যা তার "চলতি মূলধন" হিসেবে কাজ করে।অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এজেন্টকে টাকা জমা করার পরিবর্তে তার ক্রেডিট লাইন বৃদ্ধি করে।ক্রেডিট লাইনের আকার কেমন হবে তা সাধারণত নির্ধারণ করা থাকে না, তবে প্রতিটা এজেন্টের টাকার লেনদেন, ভলিওম এবং কতদিন ধরে ব্যাংকের সাথে কাজ করছে তার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করে থাকে।প্রতিটা লেনদেনের সময় ক্রেডিট লাইন যেভাবে কাজ করে তা হলঃ

  • সেবাগ্রহীতার টাকা উত্তোলন(''ক্যাশ-আউট" লেনদেন) ঃ এজেন্টের একাউন্টে একই পরিমাণ ক্রেডিট করা হয়।
  • সেবাগ্রহীতার টাকা জমা("ক্যাশ-ইন লেনদেন)ঃএজেন্টের একাউন্টে একই পরিমাণ ডেবিট করা হয়।

কোন সময় যদি ব্যাংক এর ক্রেডিট লাইনের সীমা অতিক্রম করে ফেলে এবং ব্যাংক এজেন্টের হিসেবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকা গ্রহণকৃত অর্থের বিপরীতে তাহলে পিওএস ব্লক করে দেওয়া হয়,ব্যাংক হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে এই ব্লক খুলতে হয়।

ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ একটি সহজ প্রক্রিয়াঃ

  1. ব্যাংকের গ্রাহক তার ব্যাংকের কার্ড এজেন্টকে দেখিয়ে টাকা উত্তোলন,জমা অথবা স্থানান্তর যে কোন একটি কাজ করে দিতে অনুরোধ করে।
  2. এজেন্ট তার পিওএস কার্ড অথবা ব্যক্তিগত কম্পিটারে লেনদেনের ধরন বাছাই করে,লেনদেনের পরিমান প্রবেশ করে,যন্ত্রটির মধ্য দিয়ে কার্ড টি প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসে এবং সেবাগ্রহীতাকে পিন নাম্বার প্রবেশ করাতে দেয়।
  3. একটি জিপিআরএস ডায়াল আপ বা স্যাটেলাইট যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্ভারের সাথে যুক্ত হয় লেনদেনকে অনুমোদন দেওয়ার জন্য।
  4. লেনদেনটি অনুমোদিত হওয়ার পর যন্ত্রটি সেবাগ্রহীতার রশিদ প্রিন্ট করে।

বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সম্পাদনা

বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক এই সেবা দিয়ে থাকে। ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা এখন ইউনিয়ন পর্যায়েও নিয়ে গেছে। বর্তমানে এই সেবায় দিনে লেনদেন হচ্ছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর শেষে এই সেবায় আমানত ৩০ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। ঐ সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার, যার মধ্যে পুরুষ গ্রাহক ৮৫ লাখ ২২ হাজার ও নারী গ্রাহক ৮২ লাখ ৭০ হাজার। ২০২২ এর অক্টোবরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় লেনদেন হয়েছে ৫৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এজেন্ট ব্যাংকিং"Dhaka Tribune Bangla। ২০১৯-০৬-১২। ২০১৯-০৮-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-২২ 
  2. এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গ্রাহকের অর্ধেকই নারী, প্রথম আলো, ৩৯ ডিসেম্বর ২০২২