উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা

জামেয়া ইসলামিয়া ইমদাদুল উলুম উমরগঞ্জ মাদরাসা (সংক্ষেপে উমরগঞ্জ মাদ্রাসা) পূর্ব সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ৬নং কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বাটইআইল গ্রামে অবস্থিত একটি কওমি মাদ্রাসা। এটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশভূক্ত একটি কওমি মাদ্রাসা। সমাজ সংস্কারক ও মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশনা ১৮৯৮ সালে এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কওমি মাদরাসা[১]

জামেয়া ইসলামিয়া ইমদাদুল উলুম উমরগঞ্জ মাদরাসা
ধরনকওমি মাদ্রাসা
স্থাপিত১৮৯৮; ১২৬ বছর আগে (1898)
প্রতিষ্ঠাতাগণইবরাহীম আলী তশনা
মূল প্রতিষ্ঠান
দারুল উলুম দেওবন্দ
অধিভুক্তিআল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ
ধর্মীয় অধিভুক্তি
ইসলাম
আচার্যহাফিজ মাওলানা আফতাব উদ্দিন
শিক্ষার্থী৭০০ (২০২০)
অবস্থান
শিক্ষাঙ্গনমাদ্রাসা
সংক্ষিপ্ত নামউমরগঞ্জ মাদ্রাসা

প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

মাওলানা ইবরাহীম আলী তশনা ১৮৯৮ খ্রিস্ট সনে দারুল উলুম দেওবন্দ-এ উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফিরেন। দেশে ফিরে ইবরাহীম আলী নিজ এলাকার পশ্চাদপদতা দেখে বিচলিত হন এবং অর্জিত ইলম মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে উদ্যোগী হন। এ উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী ৭টি গ্রামের জনসাধারণকে নিয়ে স্থানীয় উমরগঞ্জ বাজারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে শিক্ষাদীক্ষার ওপর নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দেন। এক পর্যায়ে হলেন, ‘আমি দীর্ঘ নয় বছর বিদেশে থেকে আপনাদের জন্য সামান্য খেজুর নিয়ে এসেছি। আমার ইচ্ছা আজকের সভায় খেজুরগুলো বণ্টন করে দিই।’[২] ইবরাহীম তশনা বলেন, ‘এ খেজুর ইলমে দ্বীনের খেজুর। আজ এ মাটিতে ইলমে দ্বীনের একটি বীজ রোপণ করতে চাই, যার চারা একদিন আলোকিত করবে দেশ, যেখানে ইসলামের আলো চিরদিন জ্বলবে।’ উপস্থিত লোকজন একবাক্যে সম্মতি প্রদান করলে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহত্তর জৈন্তা অঞ্চলের প্রাচীনতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা।[৩] [৪] উমরগঞ্জ মাদ্রাসা নিয়ে জনপ্রিয় একটি লোকসঙ্গিত:

[৫]

অবদান সম্পাদনা

উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা ইসলামি শিক্ষা বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৬৮ সালে উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় সিলেট বিভাগের মধ্যে প্রথম বারের মতো নাদিয়াতুল কুরআন ট্রেনিং ক্যাম্প চালু হয় । নাদিয়াতুল কুরআন ট্রেনিং-এর উদ্ভাবক মাওলানা আব্দুল ওহহাব। শুদ্ধ পদ্ধতিতে কুরান শেখার জন্য তার উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়। কর্মসূচীর সূচনালগ্নেই নাদিয়াতুল কুরআন ট্রেনিং-এর প্রসারে উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের বিপুল অংশে এ পদ্ধতির প্রসারে ভূমিকা রাখে।[৬] ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ‘আঞ্জুমাস-ই-ইছলাহুল মুছলিমীন’। এ লক্ষ্য উদ্দেশ্য: ১। শরীয়ত বিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের ইছলাহ ও হেদায়াতের জন্য দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলীগের উছুল অনুযায়ী চেষ্টা চালানো। তাহারা ইছলাহ ও সংশোধন না হলে সামাজিকভাবে বয়কট করা। ২। এলাকার প্রত্যেক মুসলিম নর নারীর জন্য শরীয়তের জরুরি আহকাম শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও ক্বায়ীম করার চেষ্টা করা। ৩। দেশের মক্তবগুলো বাংলাদেশ নাদিয়াতুল ক্বোরআন বোর্ডের তর্জে চালু করা।

শিক্ষা আন্দোলন সম্পাদনা

উত্তর-পূর্ব সিলেটে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে এ মাদ্রাসা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে সময় সিলেট অঞ্চলে তাজবিদের সাথে কুরআন শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান ছিল না। এ মাদরাসা তাজবিদের সাথে কুরআন শিক্ষাক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করে।,[৭] আবে হায়াত, লেখক: মুফতি রহমত উল্লাহ। মাদ্রাসার এ উদ্যোগে প্রচলিত লোকসঙ্গীত,

[৮]

১৯৩০ সালে হাফিজ আহসান উল্লাহ সাহেবের শিক্ষকতার মাধ্যমে চালু হয় হিফজুল কুরআন শাখা। উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদরাসা বৃহত্তর জৈন্তিয়া অঞ্চলে ইলমে দ্বীনের প্রচার-প্রসারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে কানাইঘাট ও জৈন্তা অঞ্চল বাংলাদেশে আলিম-উলামার অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। এ বিশেষত্ব ধারণে ইমদাদুল উলুম মাদরাসার অংশগ্রহণ অগ্রগণ্য। স্থানীয় পরিসরে নানাধর্মী সংস্কারধর্মী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেয় ইমদাদুল উলুম।[৯]। ১৯৬৮ সালে উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় সিলেট বিভাগে প্রথম বারের মতো নাদিয়াতুল কুরআন-এর ট্রেনিং ক্যাম্প চালু হয় ।

ইসলামী জলসা সম্পাদনা

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ১৩২৪ হিজরি সনে এ মাদরাসা প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের প্রথম ইসলামি জলসার আয়োজন হয়।[২] [১০] ভিন্নধর্মী এ আয়োজনের খবর দ্রুতই সিলেট ও আসাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে অনুরূপ জলসার আয়োজন হতে থাকে। লোকগীতিতে ইসলামি জলসার আবেদন,

[৯]

নারী শিক্ষা সম্পাদনা

১৯৬৮ সালে উমরগঞ্জ মাদরাসায় সাপ্তাহিক মহিলা ইজতেমার আয়োজন হয়। প্রতি বুধবার মহিলাদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। এ শিক্ষাক্রমে বয়সের বিধিনিষেধ ছিল না, যেকোনো বয়সের নারী আসতে পারতেন, কোনো শ্রেণিবিন্যাসও ছিল না। বৃহত্তর জৈন্তাপুর-এর কোথাও মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৮১ সালে মহিলা মাদরাসা বা ‘উমরগঞ্জ দ্বীনীয়া ইমদাদিয়া বালিকা মাদ্রাসা’ নামে মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়। এটি সিলেটের প্রথম মহিলা মাদ্রাসা।[১১] মাদরাসার শিক্ষাসূচী: ১। তাজবীদের সহিত কুরআন শিক্ষা। ২। উর্দুতে দ্বীনিয়াত শিক্ষা। ৩। বাংলা সাহিত্য, গণিত, শ্রুতলিপি ও হস্তলিপি (বাধ্যতামূলক)। ৪। সৎ উপদেশ। ৫। কুটির শিল্প (হাতের কাজ, সেলাই ও পাকপ্রণালী ইত্যাদি)।[১২]

মহিলা জলসা সম্পাদনা

উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসার মুহ্তামিম ওলিউর রহমান-এর উদ্যোগে ১৯৭২ সালে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম ইসলামি মহিলা জলসা।[১৩] [১৪] [১৫] ১৯৮১ সালে এ মাদরাসার অধীনে চালু হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মাদরাসাতুল বানাত বা মহিলা মাদরাসা।[১৬] । এ মাদ্রাসা সিলেট বিভাগের প্রথম মহিলা মাদ্রাসা।

 
উমরগঞ্জ দ্বীনীয়া ইমদাদিয়া বালিকা মাদ্রাসার বার্ষিক মহিলা জলসা

ব্যবস্থাপনা সম্পাদনা

মূল মাদ্রাসা-ভবন ১৯৯১ সালে সুরমা নদীর ভাঙনে বিলীন হলে ১৯৯২ সালে ২.০৩ একর জমির উপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পাস ও ছাত্র-হোস্টেল পরিচালনা করেন ২৭ সদস্যবিশিষ্ট 'ম্যানেজিং কমিটি'।

মুহ্তামিমবৃন্ধ সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আল মুশাহিদ, ৬০ সালা স্মারক, জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম দারুল হাদিস মাদরাসা, কানাইঘাট ২০১৪ পৃ: ২২
  2. হায়াতে তাইয়্যিবা, লেখক: মুফতি মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ, প্রকাশকাল: ১৯৮৫
  3. রাগিব হোসেন চৌধুরী, দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ই ফাল্গুন ১৪০০ বাংলা
  4. মাসিক মদিনা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, মার্চ ১৯৬১
  5. উদাসী তশ্না, মাওলানা ওলিউর রহমান, প্রকাশকাল : ১৯৯২
  6. হিফজুল কুরআন পরিক্রমা, সরওয়ার ফারুকী, পৃষ্ঠা ৩৪, ISBN 978-98492641-4-9
  7. আঞ্চলিক ইতিহাস ফুলবাড়ী আজিরিয়া মাদ্রাসা, মুস্তানসিরুর রহমান চৌধুরী, পৃ: ৪৪।
  8. উদাসী তশ্না ও শীতালং শাহ রচিত কতিপয় রাগ, ওলিউর রাহমান, প্রকাশ: ১৯৯২।
  9. মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন, সম্পাদনা: সরওয়ার ফারুকী, মদীনা পাবলিকেশান্স, ৩৮/২ বাংলাবাজার, ঢাকা-২০০৯, ISBN: ৯৪৮-৭০০৯৯-০০৩২-৭
  10. দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ ফাল্গুন ১৪০০ বাংলা
  11. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৪ অক্টোবর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০২২ 
  12. হিফজুল কুরআন পরিক্রমা, সরওয়ার ফারুকী, প্রকাশক: দোআশ, ২০২১, পৃ:৩৫
  13. দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৬ জানুয়ারী, ২০০৯, পৃ. ৮
  14. মুসলিম জাহান, ৪ ফেব্রুয়ারি-২০০৯
  15. হিফজুল কুরআন পরিক্রমা, সরওয়ার ফারুকী, পৃষ্ঠা ৩৪, ISBN 978-98492641-4-9
  16. বাংলাদেশে মহিলা মাদ্রাসা আন্দোলন, বেগম নুরজাহান আকবর, পৃ:৪২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮