বেদবর্ণিত পুরাকাহিনী অনুসারে, উতঙ্ক বা উত্তঙ্ক (সংস্কৃত: उत्तङ्क) হলেন মরুপ্রদেশে বসবাসরত এক ঋষি। তাঁর উল্লেখ মূলত পাওয়া যায় হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে

পুরানো সংস্করণ গলিতে উতঙ্ককে ঋষি বেদের অনুসারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।‌ দ্বিতীয় সংস্করণ টিতে তার গুরু হিসেবে মহর্ষি গৌতমকে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে উভয় কাহিনীতেই গুরুশিক্ষাপ্রাপ্ত উতঙ্ক মুনিকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে গুরুপত্নীর দাবীকৃত কর্ণকুণ্ডল আনার জন্য বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

রাজমনামা একটি ফোলিওতে চিত্রকরের আঁকা উতঙ্ক মুনি হইতে তক্ষকের কর্ণকুণ্ডল চুরির চিত্র

বশিষ্ঠ মুনির শাপে নরখাদকে পরিণত হাওয়া‌ রাজা সৌদাসের নিকট ভয়হীন চিত্তে উতঙ্ক কর্ণ কুণ্ডলের সন্ধান চান। অন্তিমে বহু প্রচেষ্টার পর তিনি রাজার পত্নী মদয়ন্তীর থেকে ওই দৈব কর্ণকুণ্ডলটি পান। এ প্রসঙ্গে রাণী মদয়ন্তী কর্ণকুণ্ডলটির দৈবত্ব সম্বন্ধে জানান এবং বলেন যে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে তিনি যদি এটি কাউকে দেন তবে প্রভূত সম্ভাবনা আছে তার এই কুণ্ডলটি চুরি করার কারণ ইতোপূর্বে একাধিক ব্যক্তি ইতিকে দাবি করেছিলেন। প্রত্যাবর্তন কালে ক্ষুধার বসে গাছ থেকে ফল পাড়তে যাবার সময় (মতান্তরে তৃষ্ণার্ত মুনি জল পান করার সময়) কর্ণকুণ্ডলটি মাটিতে পড়ে গেলে নাগরাজ তক্ষক এটিকে চুরি করে ও পাতালে প্রবেশ করে। পরে ইন্দ্রদেবঅগ্নিদেবের সহায়তায় উতঙ্ক তা পাতাল থেকে আবার উদ্ধার করেন। পরবর্তীকালে উতঙ্ক মুনি রাজা জনমেজয় কে তার পিতা পরীক্ষিতের সর্প দংশনে মৃত্যুর কথা জানিয়ে তাকে নাগরাজ তক্ষক এর বিরুদ্ধে একটি যোগ্য করার পরামর্শ দেন।

শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন পাওয়া স্বল্পসংখ্যক ভাগ্যবান ব্যক্তিত্বের মধ্যে উতঙ্ক একজন ছিলেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে বর পেয়েছিলেন যে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনি নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করতে সক্ষম হবেন। এরপর থেকে মরুভূমিতে সামান্য মেঘের সঞ্চার হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটলে তা "উতঙ্ক‌কজ্জল" বলেও পরিচিতি পায়।

গুরুদক্ষিণা সম্পাদনা

হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে উতঙ্কের দুটি কাহিনী বর্তমান। প্রথম উল্লেখটি সৃষ্টির প্রথম পুস্তক আদিপর্ব গ্রন্থের "পৌষ্যপর্ব" খণ্ডকে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় উল্লেখটি পাওয়া যায় মহাকাব্যের ১৪ নম্বর পুস্তক আশ্বমেধিক পর্বের "উতঙ্কোপাখ্যান"-এ। মালয়ালম ভাষায়ও এই উপাখ্যানটির নাম‌ "উতঙ্কোপাখ্যান", তথা মুনি উতঙ্ক, উত্তঙ্ক নয়।[১] মনে করা হয় যে আশ্বমেধিক পর্বের সংস্করণটি মূল আদিপর্বের উপর ভিত্তি করেই সৃষ্ট।[২]

আদিপর্ব সম্পাদনা

আদিপর্ব অনুসারে উতঙ্ক ছিলেন ঋষি বেদের তিনজন প্রধান শিষ্যের একজন। তাকে ঋষি ধৌম্যের অনুসারীও বলা হয়েছে।[৩][১]

একদা ঋষি বেদ তার শিষ্য উতঙ্ককে বিশ্বাস করে তার উপর সমস্ত দায়ভার দিয়ে আশ্রম ত্যাগ করেন। ওই সময় ঋষিপত্নীর প্রাকৃতিক মাসিক রজনিবৃত্তি চলছিল। এমতাবস্থায় ঋষিপত্নী উতঙ্ককে প্রজনন সময়ে তার সঙ্গে সহবাসের জন্য আহবান করলে উতঙ্ক তা করতে অস্বীকার করেন এবং এবং তিনি তাঁকে জানান যে তিনি আমৃত্যু তার গুরুর আদেশ অনুযায়ী চলবেন। অতঃপর ঋষি বেদ যথা সময়ে তার আশ্রমে ফিরে এলে তিনি এই কথা জানতে পেরে উতঙ্কের ওপর সন্তুষ্ট হন এবং তাকে আশীর্বাদ করেন।[১]

 
নাগরাজ তক্ষক

শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর গুরু বেদ তার শিষ্য উতঙ্কের কাছে গুরুদক্ষিণা দাবি করেন। তিনি আরো বলেন উতঙ্ক যেন সে গুরুপত্নী নিকট গিয়ে তার মনোবাসনা জেনে আসে। গুরুপত্নী এসময়ে বদলা নেওয়ার কথা মনে মনে পোষণ করেন কারণ উতঙ্ক তাকে প্রজননকালে নাকচ করেছিলেন। তিনি উতঙ্ককে তিন দিনের মধ্যে রাজা পূষ্যের স্ত্রী মদয়ন্তীর নিকট একজোড়া কর্ণকুণ্ডল আনার কথা বলেন যেন তিনি চতুর্থ দিনের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তা পড়তে পারেন। এই কথা শোনার পর উতঙ্ক তা পূরণ করতে গুরুগৃহ ত্যাগ করে। যাত্রা পথে তার সাথে দেখা হয় এক বিরাট আকৃতির দানবের যিনি তার বৃহদায়তন ষাঁড়ের উপর প্রবিষ্ট ছিলেন, তুষ্ট হয়ে তিনি উত্তঙ্ককে আশীর্বাদ করেন‌ এবং ওই ষাঁড়ের গোবর ও গোমূত্র পান করার পরামর্শ দেন। প্রাথমিকভাবে ইতস্তত বোধ করলেও পরে নিজের গুরু বেদের ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে উতঙ্ক তা গ্রহণ করেন। যথারীতি এরপর উতঙ্ক রাজা পূষ্যের নিকট যান‌ এবং শাপগ্রস্থ নরখাদক রূপী রাজার নিকট গুরুপত্নীর ইচ্ছা এবং কর্ণকুণ্ডলের কথা ব্যক্ত করেন। রাজা তখন উতঙ্ককে তার পত্নীর কক্ষের নিকট গিয়ে দেখা করতে বলেন। সেখানে গিয়েও উতঙ্ক রাণীকে দেখতে না পেয়ে রাজার কাছে গেলে রাজা জানান যে তার রাণী সকলের কাছে ধরা দেন না। তিনি এও জানান যে পুণ্যস্নান করে তবেই রাণীর দেখা পাওয়া যাবে। কথা মত পুণ্যস্নান করে উতঙ্ক রাণীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তার গুরুপত্নীর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। সমস্ত ঘটনা জেনে রাণী উতঙ্ককে কর্ণকুণ্ডল দান করেন এবং সাবধান করেন যে নাগরাজ তক্ষক ওই একই দৈব কর্ণকুণ্ডলের জন্য আগ্রহী, তাই তিনি যেন যাত্রাপথে এটিকে আড়াল করে নিয়ে যান।[১]

উতঙ্ক, রাণীর সাথে সাক্ষাতের পর রাজা তাকে ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান। নৈশভোজের জন্য বানানো খাবার শীতল ছিল এবং তাতে ভুলবশত চুল পাওয়া যায়। অপমানিত হয়ে মুনি রাজা কে অভিশাপ দেন যে তিনি তার দৃষ্টিশক্তি হারাবেন। ক্রোধান্বিত রাজা মুনিকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে মুনি উতঙ্কের কখনো কোন সন্তান হবে না। রাজা তখন খাদ্য পরীক্ষার পর সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন খাদ্য হয়ত কোনো মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তাই এতে চুল পড়েছে। যাইহোক পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা উভয়েই তাদের অভিসম্পাত ফেরত নিয়ে নেন। [১]

ঋষি বেদের আশ্রমে ফেরার যাত্রাপথে মুনি উতঙ্ক একটি নদীতে স্নান করার সিদ্ধান্ত নেন। তার কাছে থাকা সমস্ত প্রকার জিনিস নদীর ধারে রেখে স্নানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ওই সময় নাগরাজ তক্ষক উলঙ্গ এক ভিক্ষাজীবির রূপ ধারণ করে ওই কর্ণকুণ্ডল চুরি করে নেন। তখন উতঙ্ক সেই ভিক্ষাজীবিটিকে ধরতে উদ্যত হলেও তিনি তা পারেন না। ততক্ষণে নাগরাজ তক্ষক আপন রূপ ধারণ করে ভূমিতে একটি গর্তের ভেতরে ঢুকে যান এবং নাগলোকে প্রবেশ করেন। ওই গর্ত বরাবর উতঙ্ক খোঁড়া শুরু করেন। উতঙ্ক কে গর্ত করতে দেখে তার সাহায্যের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র তার বজ্র অস্ত্র দান করেন। বজ্র অস্ত্রের ব্যবহারে উতঙ্ক নাগলোক অবধি গর্ত করতে সমর্থ হন। নাগ লোকে প্রবেশ করে উতঙ্ক নাগরাজ তক্ষক এবং তার সমস্ত অনুগামীদের প্রশংসা করেন এবং কর্ণকুণ্ডল ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও লুক্কায়িত তক্ষক তা ফিরিয়ে দেন না।[১][৩]

উতঙ্ক তখন লক্ষ্য করেন দুজন অপরূপ সুন্দরী নারী দেওয়ালের সাথে চাকার উপর সাদা এবং কালো সুতোর আকারে অবস্থান করছেন। ওই চাকাটি বারোটি শিক ছিল এবং তা ছয় জন বলিষ্ঠ পুরুষ দ্বারা চালিত হচ্ছিল। চাকাটি নিকটেই এক অশ্ব এবং একজন অশ্বচালকও ছিলেন। উতঙ্ক এই বুনন পদ্ধতিটির প্রশংসা করেন এবং অশ্বারোহীর সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের সাদৃশ্য খুঁজে পান। প্রশংসায় সন্তুষ্ট হয়ে অশ্বারোহী উতঙ্ককে তার মনের ইচ্ছা বলতে বলেন। উতঙ্ক জানান যে তিনি স‌র্পকুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে চান। অতঃপর অশ্বারোহী উতঙ্ককে ঘোড়ার পশ্চাদদেশে ফু দিতে বললে তিনিও পরামর্শ অনুযায়ী তা করেন। ঐ ঘোড়ার সমস্ত ইন্দ্রিয় থেকে সধূম অগ্নিশিখা ঠিকরে বেরোয় এবং সমস্ত নাগরাজ্য আগুন ও ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে আতঙ্কগ্রস্থ তক্ষক নিজের গুপ্ত অবস্থান প্রকাশ করতে বাধ্য হন এবং উতঙ্ককে ওই কর্ণকুণ্ডল দান করেন।[৪][১]

কীভাবে গুরুর আশ্রমে যাবেন এবং প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে গুরুপত্নীকে তার আকাঙ্খিত কর্ণকুণ্ডল দান করবেন সেই বিষয়ে উতঙ্ক যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এই সময় কোন প্রকার আর্জি ছাড়াই অশ্বারোহী নিজের অশ্ব উতঙ্ককে দান করেন এবং আশ্বাস দেন যে এই অশ্ব উচিৎ সময়ে তাকে তার গুরুগৃহে পৌঁছে দিয়ে আসতে সক্ষম। সূর্যাস্তের সময়েও উতঙ্কের আগমন নিশ্চিত করতে না পেরে গুরুপত্নী তাকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য উদ্যত হন কিন্তু উচিৎ সময়ে, সূর্যাস্তের পূর্বেই তিনি আকাঙ্ক্ষিত কর্ণকুণ্ডল নিয়ে গুরুগৃহে প্রবেশ করেন। উতঙ্ক ফেরার পর তার যাত্রাবৃত্তান্ত গুরু ও গুরুপত্নীকে জানালে উভয়ই তাঁকে আশীর্বাদ করেন। পরবর্তীকালে ঋষি বেদ তার শিষ্যকে নাগলোকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। বুননে নিয়োজিত দুই নারী ছিলেন যথাক্রমে ধাতা ও বিধাতা, তারা বিশ্ব এবং বিশ্বের সমস্ত প্রাণীজগৎ সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সাদা এবং কালো সুতোদুটি হলো দিনরাত্রি। চাকাটি হলো বর্ষ চক্র এবং তার সংলগ্ন বারটি শিক হলো বারটি মাস। ছয় বলিষ্ঠ পুরুষ হলেন ছটি ঋতু। দৈত্যাকৃতি ব্যক্তি এবং তার ষাঁড় হলেন যথাক্রমে ইন্দ্রদেব এবং তার বাহন ঐরাবত। গোবর এবং গোমূত্র ছিল অমৃত, যা উতঙ্ককে নাগলোকেও জীবিত রাখতে সাহায্য করেছিল। নাগলোকের অশ্ব এবং অশ্বারোহী হলেন যথাক্রমে ইন্দ্রদেব এবং অগ্নিদেব। ঋষি বেদ উতঙ্ককে এও জানিয়েছিলেন যে‌ তার সমগ্র যাত্রাপথে ঋষিমিত্র ইন্দ্র তাকে সাহায্য করেছিলেন।[১][৫]

সব শেষে গুরু বেদ উতঙ্ককে গৃহে যেতে বললেন। এরপর উতঙ্ক হস্তিনাপুরে গিয়ে রাজা জনমেজয়কে তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেবার পরামর্শ দেন। তিনি রাজা জনমেজয়কে তার পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যু সম্পর্কে এবং তার পিছনে নাগরাজ তক্ষকের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করে সর্প সত্র যজ্ঞ করতে বলেন।[১][৬] তিনি নিজেও সেই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সর্পসত্র হলো এমন একটি যজ্ঞ যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা সর্পকুলকে হুতাগ্নিতে দহন করা যায়। ভীতসন্ত্রস্ত নাগরাজ তক্ষক তখন ইন্দ্রদেবের শরণাপন্ন হন এবং তার মুকুট জড়িয়ে ধরে থাকেন। উত্তম এই কথা আঁচ করতে পেরে মন্ত্রোচ্চারণে নিশ্চিত করেন যেন ইন্দ্রদেবের মুকুট সহ তক্ষক যজ্ঞবেদীতে উপস্থিত হয়। ইন্দ্রদেব তক্ষকের পাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে পলায়ন করেন। এমতাবস্থায়, ঋষি জরৎকারুর সুদর্শন, সুকুমার, শাস্ত্র জ্ঞান সম্পন্ন আস্তিক মুনি রাজা জনমেজয়ের আয়োজিত এই যজ্ঞে হস্তক্ষেপ করেন। তক্ষকের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, তক্ষক জনমেজয়কে বরপ্রদানে কথা বলেন। এই অবসরে আস্তিক তিনবার 'তিষ্ঠ' উচ্চারণ করলে অর্ধপথে শূন্যের উপর তক্ষকের পতন থেমে যায়। তিনি ওই স্থানে উপস্থিত হয়ে সর্পসত্র বন্ধ করার আদেশ দেন এবং তক্ষকের প্রাণ রক্ষা করেন।

শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার সম্পাদনা

 
অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন

অশ্বমেধিক পর্বতে শ্রীকৃষ্ণের সাথে উতঙ্কের আলাপচারিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। নিজের রাজ্য দ্বারকার দিকে প্রত্যার্পণের পথে শ্রীকৃষ্ণ আশ্চর্য তপস্বী উতঙ্ককে লক্ষ্য করেন। মুনি উতঙ্ক কৃষ্ণের সাথে সাক্ষাতের পর কুশল সংবাদ গ্রহণ করেন। কৃষ্ণ তাকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিধ্বংসী বিবরণ দেন। পরস্পর ভ্রাতা কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসা না করে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কথা শুনে মুনি উতঙ্ক শ্রীকৃষ্ণকে একপ্রকার ভর্ৎসনা করা শুরু করেন। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ এই যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাস্বরূপ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন এবং নিজের বিশ্বরূপ দর্শন করান। মুনি কৃষ্ণের প্রতি মাথানত করলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বর যাওয়ার অনুমতি দেন। উতঙ্ক শ্রীকৃষ্ণকে বলেন যেন তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তিনি যেকোনো স্থানে জলের সন্ধান পান। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন।[১][৭] অর্জুন এবং ভীষ্ম ছাড়া তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন পান।[৮]

পরবর্তীকালে কোন একসময় মরু প্রদেশ ভ্রমণকালে মুনি উতঙ্ক তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন এবং শ্রীকৃষ্ণ থেকে প্রাপ্ত বর অনুযায়ী চারিদিকে জলের অনুসন্ধান করা শুরু করলে সামনে প্রস্রাবরত এক চণ্ডালকে দেখতে পান। উক্ত চণ্ডালের সারা গা কর্দমাক্ত ছিল এবং একাধিক কুকুর তাকে ঘিরে রেখেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে চণ্ডালটি নিজে থেকেই মুনিকে বারবার তার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য বলছিলেন। কিন্তু উতঙ্ক তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে চণ্ডালটি অদৃশ্য হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণের আগমন ঘটলে উতঙ্ক পানীয় জলের বদলে তৃষ্ণার্ত ব্রাহ্মণের চণ্ডালমূত্র পানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। কৃষ্ণ তাকে জানান যে তিনি ইন্দ্রদেবকে অমৃত নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 
রজমনামার ফলিও চিত্রে উলঙ্গ মুনির সম্মুখ থেকে চণ্ডালরূপী ইন্দ্রের অন্তর্ধান

যুক্তিবাদী বাক-বিতণ্ডার পর কৃষ্ণ উতঙ্ক কে বলেন যে ঐ চণ্ডালের কাছ থেকে তার অমৃতপান প্রত্যাখ্যান করা কি ভুল হয়েছে। এরপরেও কৃষ্ণ তার প্রদত্ত বর তথা তৃষ্ণা নিবারণের জন্য যেকোনো স্থানে জলের সন্ধান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটি বর্তমান রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি উত্তরে বলেন যে তার তৃষ্ণায় মরুভূমিতে জলপূর্ণ মেঘ উপস্থিত হবে এবং যৎপরোনাস্তি বর্ষণ করবে। এখনো মরুভূমিতে ঘন কালো মেঘ দেখা গেলে এবং ভারী বর্ষণ হলে তাকে 'উতঙ্ককজ্জল' বা 'উতঙ্ক মেঘ' বলা হয়।[৯][১][৭]

এই ঘটনার আরেকটি সংস্করণ অনুযায়ী, উতঙ্ককে পরীক্ষা করতে কৃষ্ণ স্বয়ং অস্পৃশ্য অশুচি ব্যাধের বেশ ধরে তার নিকট আসেন এবং মুনির তৃষ্ণাকালে তার প্রস্রাবদূষিত পানীয় পান করতে বলেন।‌ উতঙ্ক তৎক্ষণাৎ এই প্রস্তাব নাকচ করে কারণ ওই ব্যাধ ছিল ম্লেচ্ছ ও অস্পৃশ্য। এরূপ ব্যবহারে কৃষ্ণ অসন্তুষ্ট হন এবং উতঙ্কের সামনে নিজের আসল রূপের প্রকাশ ঘটান। [১০]

অন্যান্য ঘটনাবলী সম্পাদনা

মহাভারতের বনপর্বে উল্লেখ রয়েছে ধুন্ধু নামে এক অসুর মরুধন্ব স্থানের উজ্জলক মরুভূমির বালিয়াড়িতে বাস করতো। এই অসুর সারা বিশ্বকে এই আতঙ্কগ্রস্থ করেছিল। অসুরের এই কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে উজ্জলক আশ্রমনিবাসী উতঙ্ক মুনি শ্রী বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে ঘোর তপস্যা শুরু করেন। সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাকে আশ্বস্ত করেন যে, ইক্ষ্বাকু বংশের বীর প্রতাপশালী রাজা কুবলাশ্ব এই অসুরকে কে পরাস্ত করবে। মুনি তখন সন্ন্যাসী রাজা বৃহদশ্বর নিকট যান এবং তাকে সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী বিস্তারিত করেন। রাজা তখন তার পুত্রকে মুনির কথা মেনে চলার আদেশ দেন এবং আবার আরণ্যগমন করেন। কুবলাশ্ব তখন একুশ হাজারের অধিক সৈন্য নিজ পুত্রগণ এবং মুনিকে নিয়ে উজ্জলকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাত্রাকালে শ্রীবিষ্ণু তাকে নিজের শক্তি অর্পণ করেন। অসুর ধুন্ধু বরপ্রাপ্ত ছিলেন যে কোনো দৈবশক্তি তার প্রাণ হনন করতে পারবে না। মরুভূমির পশ্চিম প্রান্তে তার বাস ছিল। রাজা সহ মুনি সেই স্থান খুঁজে লক্ষ্য করেন শত শত দানব-অসুর ধুন্ধুর বিরাট আকৃতির দেহের চারদিকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। রাজা ও তার সিংয়ের কথা আন্দাজ করতে পেরে তারা অগ্নিবমন করলে নিমেষেই একুশ হাজার সৈন্য ভষ্মীভূত হয়। দৈব শক্তির অধিকারী রাজা অগ্নি বমন ও বারিধারাকে উপেক্ষা করে ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা অসুর হত্যা করে। তার সমস্ত পুত্রদের মধ্যে তিন পুত্র প্রাণে বেঁচে যায়। আনন্দিত দেবতা এবং ঋষিগণ তাকে আশীর্বাদ ও বর প্রদান করেন। অসুর ধুন্ধুকে হত্যা করার জন্য রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধুমার উপাধি গ্রহণ করেন।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Mani, Vettam (১৯৭৫)। Puranic Encyclopaedia: a Comprehensive Dictionary with Special Reference to the Epic and Puranic Literature। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 240, 815–6। আইএসবিএন 978-0-8426-0822-0 
  2. Vogel 1926, পৃ. 65–6।
  3. Vogel 1926, পৃ. 62।
  4. Vogel 1926, পৃ. 62–3।
  5. Vogel 1926, পৃ. 63।
  6. Vogel 1926, পৃ. 64।
  7. Renuka Narayanan (এপ্রিল ২৩, ২০১১)। "The epic tale of Utanka's error"Hindustan Times। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  8. Mehta 1992, পৃ. 130।
  9. Heinrich 2002, পৃ. 21।
  10. "Uttanka"। Encyclopedia for Epics of Ancient India। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৩