উইকিপিডিয়া:উইকিপত্রিকা/পৌষ ১৪৩১/সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার

উইকিপিডিয়ার প্রত্যেকটা লাইনই হওয়া উচিত নিরপেক্ষ এবং মানবকল্যাণমুখী

গত ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা জিসি রায় ওরফে গোপাল চন্দ্র রায় দাদার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। অনেকে হয়তো তাকে Gc Ray ইংরেজি বানানে বেশি চিনে থাকবেন। তিনি একটা দীর্ঘ সময় আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে নিজের মতামত প্রদান করতে প্রচুর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সমস্যা আর ব্যক্তিগত ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে এই সাক্ষাৎকারটি নিজের জায়গা দখল করেছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন খাত্তাব হাসান। এছাড়া প্রযুক্তিগত ও বক্তব্যকে লেখায় রূপান্তর করতে সহায়তা করেছেন মেহেদী আবেদীন।


প্রধান সম্পাদক: স্বাগতম দাদা, আমরা বোধহয় শুরু করতে পারি। প্রথমে আমি আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি খাত্তাব হাসান, উইকিপত্রিকার সম্পাদক। পাঠকদের জন্য আপনার পরিচয়টা দিবেন অনুগ্রহ করে। উইকিপিডিয়ানদের জন্য আপনার পরিচয়টা কি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে? যেমন, আমি আপনাকে দীর্ঘদিন জিসি রায় নামেই চিনেছি। পরে আপনার ব্যবহারকারী পাতায় গিয়ে আপনার নাম জানতে পেরেছি।

জিসি রায়: আমি গোপাল চন্দ্র রায়। আমি নামটাকে সংক্ষেপ করে জিসি রায় ব্যবহার করেছি। পেশায় একজন শিক্ষক, কিন্তু কোন স্কুলের নয়। আমার একটি ছোট কোচিং সেন্টার আছে।

প্রধান সম্পাদক: আপনার উইকিপিডিয়ায় আসার গল্পটা কেমন ছিল, ঠিক কী কারণে আপনি উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখতে শুরু করেন?

জিসি রায়: আমি বিভিন্ন ধর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থ, ধর্মীয় মতবাদ এবং বিশেষত হিন্দুধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম। আমাদের ধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম বা সনাতন ধর্ম সম্পর্কে আরো ভালো জানার ইচ্ছায় আমি উইকিপিডিয়াকে পছন্দ করি। আমি উইকিপিডিয়ায় কাজের মাধ্যমে এবং আমার বোধগম্যতার আলোকে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি, সেটি আমার ব্যবহারকারী পাতায় উল্লেখ করেছি। তবে একটু আপত্তির সাথে বলতে হয়, উইকিপিডিয়ায় আমার ধর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধের অভাব ছিলো। হয়তো কিছুটা আমি সম্পন্ন করতে পেরেছি।

প্রধান সম্পাদক: উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখার পর অনেকে অনিয়মিত হয়ে যায় আবার অনেকে চলে যায়। আপনাকে কোন বিষয়টি উইকিপিডিয়ায় নিয়মিত অবদান রাখতে উৎসাহিত করছে?

জিসি রায়: আমি সাধারণত চেইন ভিত্তিক কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে নতুন বিষয় সামনে আসে, সেই আকর্ষণ আমাকে চলমান রেখেছে। আমি শুধু হিন্দু ধর্মের নিবন্ধই করিনাই। বেশ কয়েকটি ধর্মের নিবন্ধ তৈরি করেছি।

প্রধান সম্পাদক: জি, ধর্ম ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতেও আপনার উপস্থিতি আমরা সমানভাবে দেখেছি। উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখতে গিয়ে কি আপনি কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন? হলে সেগুলো কী কী আর সেসব প্রতিবন্ধকতাগুলো আপনি কিভাবে কাটিয়ে এতোটুকু আসতে সক্ষম হলেন?

জিসি রায়: আমি প্রথমদিকে কিছু সমস্যার মধ্যে পরেছি। তখন বিশেষ ভাবে সহযোগিতা করেছেন দেলোয়ার আকরাম ভাই। পরবর্তীতে আফতাবুজ্জামান ভাইসহ অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে আমি উইকিপিডিয়া সম্পর্কে অতটা দক্ষ ছিলাম না। টেকনিক্যালি অনেক সমস্যা আমার ছিল। এ ব্যাপারে দেলোয়ার আকরাম ভাই আমাকে সাহায্য করেছেন। পরবর্তীতে আফতাব ভাইসহ অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার আন্তঃসংযোগ দিতে সমস্যা ছিল। ওটা আফতাব ভাই আর দেলোয়ার ভাই আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া ইংরেজি উইকিতে একটা ছেলেকে সাহায্য করার জন্য সকপাপেট্রির হুমকির মধ্যে পড়েছিলাম। ঐ সময়ে আফতাব ভাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন।

প্রধান সম্পাদক: আপনি তো মনে হয় দীর্ঘদিন ধরেই ধারাবাহিক অবদান রাখছেন, এমনকি আপনি আমার থেকে নতুন হলেও আপনি কিন্তু আমার থেকে ভালো অবদান রেখেছেন। এটা যে আপনি ধরে রেখেছেন, ধারাবাহিক অবদান রাখলেন, আপনি এটা কীভাবে করলেন বা ছেড়ে দিতে মন চেয়েছিল কিনা?

জিসি রায়: আসলে আমার ইচ্ছাটা কি, উইকি একটা বিশ্ব গণমাধ্যম যেখানে জ্ঞানভাণ্ডার আছে। ওই জ্ঞানভাণ্ডারকে টার্গেট করে আমি কাজ করেছি। আর আমার ধর্ম সম্পর্কে জানা, অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানা, এটা আমার আগ্রহের বিষয়। সেজন্যই আমি এটাকে ছাড়তে চাইছিনা আর লিংক হিসেবে কাজ করি তো, একটা করতে গেলে আরেকটি আসে। ওইটাই আমার আনন্দ। একটা করতে গিয়ে আরেকটি জানতে পারি। সেটা জানার পর আরেকটা জানি। ওই আগ্রহ থেকে আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রধান সম্পাদক: আপনি তো বোধহয় বেশিরভাগ অনুবাদ করেন নিবন্ধ। আপনি কি মৌলিক নিবন্ধ তৈরি করেছিলেন কখনো?

জিসি রায়: জি, অনুবাদই করি। ব্যক্তিগতভাবে মৌলিক কিছু করা হয় নাই। তবে আমি ইংলিশ উইকি থেকে ট্রান্সলেট করি আরকি।

প্রধান সম্পাদক: যদিও আপনি নিবন্ধ অনুবাদই বেশি করেন কিন্তু আপনি মৌলিক নিবন্ধ ও অনুবাদ নিবন্ধের মধ্যে কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?

জিসি রায়: আসলে মৌলিক নিবন্ধ করার ইচ্ছা আছে তবে সেটা পরবর্তীতে আরও জানার পরে আরও বোঝার পরে এটা করতে চাচ্ছি। বর্তমানে আপাতত ইংলিশ উইকি থেকেই প্রয়োজনীয় যে নিবন্ধগুলো আছে সেগুলো ট্রান্সলেট করার ইচ্ছা আমার আছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমার গুরুত্ব ধর্মের দিক থেকে।

প্রধান সম্পাদক: উইকিপিডিয়ায় অনেক নীতিমালা আছে। আপনি ইতোমধ্যে অনেক নীতিমালার সাথে পরিচিত হয়েছেন। উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখতে নীতিমালা জানা কতটুকু জরুরি বা কাজ করতে এগুলো জানা কতটুকু দরকার হয়?

জিসি রায়: অবশ্যই নীতিমালা মানা উচিত। কারণ এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্লাটফর্ম। এখানে ভুল, অযৌক্তিক নিবন্ধ সৃষ্টি করা উচিত না। কারণ এটা তো বিশ্বের অনেক লোকই অধ্যয়ন করে। সঠিক তথ্যই দেওয়া উচিত। তবে আপনাদের কাছে আমার আবেদন, কিছু কিছু লোকজন হঠাৎ করে ঢুকে কিছু কিছু নিবন্ধ তৈরি করে যেগুলো বিতর্কিত, সেগুলো বন্ধ করা উচিত আমার মনে হয়। এই উইকিপিডিয়াকে বিশ্বের অনেক লোকই বিশ্বাসের জায়গা থেকে দেখে। দেখুন, আগামীকাল আমি হয়তো থাকবো না, আপনি থাকবেন না, আমরা থাকবো না। কিন্তু এটা রেকর্ড থেকে যাবে। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম এখান থেকে রেফারেন্স দিতে পারে যে, এটা সত্য।

প্রধান সম্পাদক: জি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আপনি ভবিষ্যতে নিজেকে কোন অবস্থায় বা কোন উচ্চতায় উইকিপিডিয়াতে দেখতে চান মানে আপনার কোন পরিকল্পনা আছে কিনা যে ওই জায়গায় বা ওই ধরনের কাজ করতে চাই ভবিষ্যতে?

জিসি রায়: এই ধরনের কোন পরিকল্পনা আমার নাই। আমার ইচ্ছা আছে যে ভালো কিছু করে যাওয়ার।

প্রধান সম্পাদক: আচ্ছা, আপনার ব্যক্তিগত জীবনে উইকিপিডিয়া কি কোন প্রভাব ফেলেছে কিনা বা ব্যক্তিগত জীবনে কোন সমস্যা আছে কিনা বা অতিরিক্ত এখানে সময় দেওয়ার জন্য কোন কষ্ট হচ্ছে কিনা? এই বিষয়টা আপনি এখানে মানে ব্যক্তিগত জীবনের সাথে উইকিপিডিয়াকে কিভাবে সমন্বয় করেন?

জিসি রায়: আসলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন সমস্যায় পড়িনি। এটা তো ভালোই লাগে। মানে অবসর টাইমটা এখানে ব্যয় করি।

প্রধান সম্পাদক: জি আচ্ছা। এমনিতে কি আপনি উইকিমিডিয়া আন্দোলনের সাথে আছেন বা এর কোন কাজের সাথে, যেমন আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দেই; দেলোয়ার আকরাম ভাইয়ের কথা বললেন। উনি কিন্তু উইকিমিডিয়া আন্দোলনের সাথে জড়িত আছেন। আপনি কি এই ধরনের কোন আন্দোলনের সাথে বা অফলাইন কার্যক্রমের সাথে জড়িত আছেন?

জিসি রায়: না, এই ধরনের কিছুর সাথে জড়িত নেই।

প্রধান সম্পাদক: এমনিতে আপনার পরিচিতজন কেউ আছে যারা উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখেন বা আপনি তাদেরকে অবদান রাখতে আগ্রহী করেছেন বা এই ধরনের কিছু?

জিসি রায়: না, আমি কাউকে ইন্টারেস্ট করিনি। আমি নিজেই কাজগুলি করি।

প্রধান সম্পাদক: এমনিতে আপনার পরিচিতজনদের কাউকে দেখে শিখেছেন এমন কেউ আছে কিনা নাকি নিজেই একা কিভাবে অনলাইন থেকে দেখে দেখে নিজে নিজে শুরু করেছেন, নিজে নিজে করছেন এমন?

জিসি রায়: নিজে নিজেই। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে।

প্রধান সম্পাদক: নতুনদের কী পরামর্শ দিবেন?

জিসি রায়: আসলে উইকিপিডিয়া হচ্ছে বিশ্ব জ্ঞানকোষ। এখানে প্রত্যেকটা মানুষের উচিত জেনে বুঝে কাজ করা, তবে কাজ ছেড়ে না দেওয়া। ভুল হতে পারে। সেই ভুলটার মাধ্যমে শেখা উচিত। কাজ করতে করতে মানুষ দক্ষ হয়। কাজ ছেড়ে দিলে মানুষ দক্ষতা পাবেনা। আর ধর্মীয় বিষয়ে কখনো ব্যক্তি মত স্থাপন করা উচিত নয়। ধর্ম হচ্ছে নিরপেক্ষ, সেখানে কোন ব্যক্তিমত প্রযোজ্য না। সেটা হওয়া উচিত সার্বজনীন।

প্রধান সম্পাদক: পুরোনোদের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইবেন? অনেকে আছেন, যারা নতুনদের প্রতি খুবই রুক্ষ ব্যবহার করে বা এই ধরণের কিছু।

জিসি রায়: নাম বলবো না, কিছু লোক আছে তারা.. আসলে কি ব্যাপারটা হচ্ছে যে আমি তো ধর্মীয় কাজ করি, ধর্মীয় বিষয়ে কিছু কিছু মতাদর্শ আমাদের ধর্মে আছে। যারা যে মতাদর্শের ব্যক্তি ঠিক সেগুলোই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটা হওয়া উচিত নয়। ধর্মীয় বিষয়ে স্বতন্ত্র মনোভাব থাকা উচিত। যারা এগুলো করে তাদের এগুলো বর্জন করা উচিত। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। নাম বলবো না, আমি কিছু লোককে চিনি-জানি। তারা আমার অনেক কাজের বিরোধিতা করেছে। আমি আবার সেগুলো সংশোধনও করেছি। আসলে ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যেগুলো মার্ভেলাস ধর্ম প্রতিষ্ঠিত আছে পৃথিবীতে, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় সাংঘর্ষিক কোন কাজ করা উচিত নয়। হওয়া উচিত এমন যে যেটা সবাই মানবে, সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে, সেই ধরনের অবদান রাখাই উচিত উইকিপিডিয়াতে, যেহেতু উইকিপিডিয়া বিশ্বকোষ, আগামী প্রজন্ম এই কর্মগুলো থেকে শিক্ষা লাভ করবে, সেগুলো তারা জানবে এবং বুঝবে। সেখানে যদি আমরা ব্যক্তি বা সাম্প্রদায়িক মতবাদ রেখে যাই সেটা কিন্তু আগামী দিনের জন্য হুমকি হবে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। আর আমি যতটুকু জেনেছি ধর্ম সম্পর্কে, ধর্ম হচ্ছে মানব কল্যাণের জন্য। মানব কল্যাণ যদি না থাকে ধর্মের মধ্যে সেটা কিন্তু শুভকর নয়। প্রত্যেকটা লাইনই হওয়া উচিত নিরপেক্ষ এবং মানবকল্যাণমুখী। সেই মনোভাব রেখেই সবাইকে লেখা উচিত ধর্মীয় বিষয়ে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যরকম হিসাব, সেখানে সাংঘর্ষিকতা থাকতেই পারে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে কখনো সংঘর্ষমূলক কোন প্রতিবেদন বা নিবন্ধ তৈরি উচিত না। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।

প্রধান সম্পাদক: আপনাকে শুরু থেকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। যান্ত্রিক কিছু ত্রুটির জন্যও দীর্ঘ সময় কষ্ট করতে হয়েছে। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

জিসি রায়: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ যে আপনারা ধৈর্যসহকারে সময় দিলেন। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতি।