ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস (ইংরেজি: East India House) ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন সদর দপ্তর। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক কোম্পানি শাসিত ভারতের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের শাসনকার্য এ ভবন থেকেই পরিচালিত হতো। ভবনটির অবস্থান ছিল সিটি অব লন্ডনের ল্যাডেনহল স্ট্রিটের দক্ষিণ পাশে। পূর্বে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজটির অবস্থানে এলিজাবেথান ম্যানশন নামক একটি ভবন ছিল; যা আগে ক্র্যাভেন হাউস নামে পরিচিত ছিল। ১৬৪৮ সালে কোম্পানি প্রথম এই ভবনের মালিকানা লাভ করে। এরপর ১৭২৬-২৯ সালের মধ্যে তারা ভবনটি পুরোপুরি পুনর্নির্মাণ করে। এরপর ১৭৯৬–১৮০০ সাল পর্যন্ত ভবনটির পুনঃবিন্যাস ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৮৬১ সালে এটি ভেঙে ফেলা হয় এবং পরবর্তীতে সেখানেই লয়েড'স অব লন্ডনের সদর দফতর লয়েড'স বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ | |
---|---|
সাধারণ তথ্য | |
অবস্থা | ভেঙে ফেলা হয়েছে |
স্থাপত্য রীতি | নিওক্লাসিক্যাল[১] |
ঠিকানা | লিডেনহল স্ট্রিট |
শহর | সিটি অব লন্ডন |
দেশ | গ্রেট ব্রিটেন |
স্থানাঙ্ক | ৫১°৩০′৪৭″ উত্তর ০°০৪′৫৫″ পশ্চিম / ৫১.৫১৩° উত্তর ০.০৮২° পশ্চিম |
নির্মাণকাজের সমাপ্তি | ১৭২৯ |
পুনঃসংস্কার | ১৭৯৬–১৮০০ |
ভেঙ্গে ফেলা হয় | ১৮৬১ |
গ্রাহক | ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি |
উচ্চতা | |
শীর্ষ তলা পর্যন্ত | ৪ |
কারিগরী বিবরণ | |
তলার সংখ্যা | ৪ |
নকশা এবং নির্মাণ | |
স্থপতি |
|
"পুরাতন" ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ
সম্পাদনাইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু, ১৬২১ সাল পর্যন্ত তারা কেবল তাদের গভর্নর স্যার টমাস স্মিথের জন্যই কক্ষ বরাদ্দ করতে পেরেছিল, যার অবস্থান ছিল ফেনচার্চ স্ট্রিটের ফিলপট লেনে। তারপর, ১৬২১ সালে অফিসটি বিশপসগেটের ক্রসবাই হাউসে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৬৩৮ সাল পর্যন্ত সেখান থেকেই কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ১৬৩৮ সালে নতুন গভর্নর স্যার ক্রিস্টোফার ক্লিথেরো দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অফিসটিকে তার লিডেনহল স্ট্রিটের বাস ভবনে স্থানান্তর করেন। ১৬৪১ সালে ক্লিথেরো মারা গেলেও অফিসটি কোম্পানির দখলেই থেকে যায়।[২]
অতঃপর, ১৬৪৮ সালে কোম্পানি ক্র্যাভেন হাউস ইজারা নেয়। লন্ডনের লর্ড মেয়র স্যার রবার্ট লি ক্র্যাভেন হাউস (পরবর্তীতে এলিজাবেথান ম্যানশন) নির্মাণ করেন এবং তার উত্তরসূরি স্যার উইলিয়াম ক্র্যাভেনের নামে নামকরণ করেন।[৩][৪] ১৬৬১ সাল পর্যন্ত ভবনটি ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস নামে পরিচিত ছিল। সে বছরই, ভবনের সামনের অংশে কোম্পানির কয়েকটি জাহাজের চিত্রকর্ম দিয়ে সজ্জিত একটি অলঙ্কৃত কাঠের সুপার স্ট্রাকচার দেওয়া হয়েছিল, যা একটি কাঠের ভাস্কর্য দ্বারা সজ্জিত ছিল।[৫] পরবর্তী বছরগুলোতে, ভবনটির সম্প্রসারণ এবং বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছিল। ১৭১০ সালে কোম্পানি লর্ড ক্র্যাভেনের কাছ থেকে সম্পত্তিটি কিনে নেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। অবশ্য, এই ক্রয় প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন হতে ১৭৩৩ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।[৬] এরই মাঝে ভবনটি আরও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। তবে, ১৭২০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভবনটির খারাপ অবস্থা এবং কোম্পানির অফিসের জন্য আরো বেশি জায়গার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ভবনটি সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[৭] এজন্য, ১৭২৬ সালের শুরুর দিকে সংস্থাটি তাদের কার্যালয় অস্থায়ীভাবে ফেঞ্চচার্চ স্ট্রিটে স্থানান্তর করে।[৮]
"নতুন" ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ
সম্পাদনাকোম্পানির নতুন ভবনটির নকশা করেছিলেন বণিক এবং অপেশাদার স্থপতি থিওডোর জ্যাকবসেন। আর, পেশাদার স্থপতি হিসেবে কাজ করেছেন জন জেমস। ১৭২৯ সালের জুন মাসের ভবনটির মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়। ফলে, সংস্থাটি তার নতুন ভবনে মিডসামার জেনারেল কোর্ট স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়।[৯] অবশ্য, কার্যালয়ের মূল অংশ লিডেনহল স্ট্রিটেই রয়ে যায়। সেখানকার ভবনটি পিছনের দিকে যথেষ্ট সম্প্রসারণ করা হয় এবং সেখানে গুদাম নির্মাণ করা হয় যেখানে লিম স্ট্রিট থেকে পৌঁছানো যেত।[১০] আরো গুদাম এবং অন্যান্য সুবিধা উইলিয়াম জোন্স ১৭৫৩ সালে তৈরি করেন।[১১]
জ্যাকবসেন ভবনটির সম্মুখভাগের যে নকশা করেছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু খোদাই চিত্র এবং স্যামুয়েল ওয়ালের ১৭৬০ সালের একটি ডিটেইলড ওয়াশ অঙ্কন থেকে জানা যায়।[১২] ভবনটিতে পাঁচটি বে ছিল, যার প্রত্যেকটিই ছিল তিন তলার সমান উঁচু।[১৩] কাঠামোটি অপ্রত্যাশিতভাবে গভীর ছিল এতে ছিল বড় বড় সভাকক্ষ এবং পরিচালকদের কার্যালয়ের পাশাপাশি একটি হল ঘর, একটি উঠান এবং একটি বাগান। ডিরেক্টরদের কোর্ট রুমে পেডিমেন্টের নিচে ছিল দাড়িওয়ালা দুটি টার্ম ফিগারের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যান্টেল শেলফের মাঝে মাইকেল রিসব্র্যাকের ব্রিটেনিয়া রিসিভিং দ্য রিচেস অব দ্য ইস্ট নামক একটি শিল্পকর্ম।[১৪][১৫] এছাড়াও, ডিরেক্টরদের কোর্ট রুমে জর্জ ল্যামবার্টের ছয়টি ক্যানভাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূল কারখানাগুলোর ছবি অঙ্কিত ছিল। এগুলো হলো: সেন্ট হেলেনা, কেপটাউন, ফোর্ট উইলিয়াম, কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ এবং টেলিচেরি। সম্মুখের ইস্ট ইন্ডিয়ামেন চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন মেরিন চিত্রশিল্পী স্যামুয়েল স্কট।[১৬] আর, ভবনের অভ্যন্তরীণ খোদাইয়ের কাজগুলো করেছিলেন জন বোসন।
রাজস্ব কমিটির কক্ষের ছাদে দ্য ইস্ট অফারিং ইটস রিচেস টু ব্রিটেনিয়া নামক একটি ডিম্বাকৃতির চিত্রকর্ম ছিল। এটি স্বল্প পরিচিত গ্রিক শিল্পী স্পিরিডিওন রোমা ১৭৭৮ সালে অঙ্কণ করেছিলেন।[১৭]
সংস্থাটির সমৃদ্ধির সাথে সাথে অতিরিক্ত স্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা অনুভূত হতে শুরু করে। এ চাহিদা মেটাতে কোম্পানি ১৭৯০-এর দশকে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজের উভয় পাশের সংলগ্ন স্থাপনাগুলো কিনে নেয় এবং সেগুলো ভেঙে ফেলে। হেনরি হল্যান্ড কোম্পানির জন সোয়ান এবং জর্জ ড্যান্সের কাছে তদবির করে তার নকশা অনুযায়ী ভবন সম্প্রসারিত করার অনুমোদন লাভ করেন। অবশ্য, তখন কোম্পানির স্থপতির দায়িত্বে ছিলেন রিচার্ড জুপ। নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়েছিল ১৭৯৬ সালে। কিন্তু, ১৭৯৯ সালের এপ্রিলে জুপ আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে ভবনের বাকি কাজ হেনরি হল্যান্ডই সম্পন্ন করেন।[১৮][১৯][২০] এই সম্প্রসারিত অংশগুলোর মধ্যে একটি অংশে নির্মাণ করা হয় সংস্থাটির জাদুঘর এবং অপর অংশে গড়ে তোলা হয় পাঠাগার।
বিখ্যাত প্রাবন্ধিক চার্লস ল্যাম্ব ১৭৯২ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজের একজন কেরানী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।[২১] ১৮২৬ সালে হেনরি হপনার মেয়ারের আঁকা ল্যাম্বের প্রতিকৃতিতে তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসের সামনে বসা অবস্থায় দেখা যায়।[২২] তার "দ্য সুপারঅ্যানুয়েটেড ম্যান" প্রবন্ধে তিনি আলোহীন পেন্ট-আপ অফিসগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে দেড় বছর সূর্যের আলোর জায়গায় মোমবাতিগুলোই আলো সরবরাহ করত। এছাড়াও, সেখানে তিনি ফিশ স্ট্রিট হিল, ফেনচার্চ হিল এবং মাইনিং লেনের কথা উল্লেখ করেছেন; কেননা এ পথেই তিনি লিডেনহল স্ট্রিটে কাজ করার জন্য যেতেন।[২৩]
১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলুপ্ত করা হলে এর সমুদয় সম্পদ ব্রিটিশ সরকারের হস্তগত হয়। সরকার এই ভবনটিকে ভারত অফিসে পরিণত করে। অবশ্য, এটি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল; কেননা হোয়াইটহলের জন্য এরই মধ্যে একটি নতুন ইন্ডিয়া অফিস ভবনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ১৮৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস খালি হয়ে যায় এবং পরের বছর ভবনটি বিক্রি করে দেওয়া হয়।[২৪][২৫] সেই জায়গাটিতেই এখন লয়েড'স বিল্ডিংয়ের অবস্থান। পুরানো ভবনের অধিকাংশ জিনিসপত্র, শিল্প সংগ্রহ এবং আসবাবপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছিল; যার কিছু অংশ বর্তমানে লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাস ভবন- ইন্ডিয়া হাউসে সংরক্ষিত আছে;[২৬] আর বাকি অংশ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে এর "এশিয়া, প্যাসিফিক এবং আফ্রিকা সংগ্রহশালা"র অংশ হিসাবে সংরক্ষিত আছে।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Crinson, Mark (১৯৯৬)। Empire Building: Orientalism and Victorian Architecture। London: Routledge। পৃষ্ঠা 65। আইএসবিএন 0-415-13940-6। সংগ্রহের তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- ↑ Foster 1924, pp. 1–19.
- ↑ Foster 1924, pp. 17–24.
- ↑ Brayley, E. W. (১৮২৯)। Londiniana, or, Reminiscences of the British metropolis। 4। London: Hurst, Chance। পৃষ্ঠা 299।
- ↑ Foster 1924, pp. 42, 125–9.
- ↑ Foster 1924, pp. 44–9.
- ↑ Foster 1924, pp. 50–52, 129–31.
- ↑ Foster 1924, pp. 130–31.
- ↑ Foster 1924, pp. 131–32.
- ↑ Foster 1924, pp. 132.
- ↑ Foster 1924, p. 136.
- ↑ Archer 1965, p. 401, fig. 1.
- ↑ In 1726-29 the South Sea Bubble was a vivid recent memory.
- ↑ The chimneypiece and overmantel have been reinstalled in the Council Chamber, Commonwealth Relations Office, Downing Street: Archer 1965, p. 402, fig. 3.
- ↑ Foster 1924, pp. 134–5.
- ↑ The topography must have been copied from contemporary engravings, as neither artist had visited the East: Archer 1965, p. 404.
- ↑ Archer 1965:406, as "Spiridoma Roma". Roma had worked for Horace Walpole's friend, John Chute, at The Vyne, Hampshire, where he decorated the chapel with painted Gothic fanvaulting; in London he developed a reputation as a paintings restorer
- ↑ Foster 1924, pp. 137–44.
- ↑ Archer 1965, p. 408.
- ↑ Stroud, Dorothy (১৯৬৬)। Henry Holland: his life and architecture । London: Country Life। পৃষ্ঠা 140f, fig. 118। (Holland's design for the front of East India House, as executed).
- ↑ Lamb 1953, pp. 5, 7.
- ↑ Meyer, Henry Hoppner। "Charles Lamb (1775–1834), Clerk in the East India House (1792–1825)"। Art UK। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৯।
- ↑ Lamb 1953, pp. 246–47.
- ↑ Foster 1924, pp. 153–4.
- ↑ Robins, Nick (২২ জানুয়ারি ২০০৩)। "Loot: In search of the East India Company"। Corporate Rule। ২৬ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০১৩।
- ↑ Archer 1965, p. 409.
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- Archer, Mildred (নভেম্বর ১৯৬৫)। "The East India Company and British art"। Apollo: 401–09।
- Foster, Sir William (১৯২৪)। The East India House: its History and Associations। London: John Lane।
- Lamb, Charles (১৯৫৩)। May, J. Lewis, সম্পাদক। Selected Essays, Letters and Poems। London: Collins।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- বাংলাপিডিয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ
- পোর্টসিটিজ-এ দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে