স্তন্যদান বা বুকের দুধ খাওয়ানোকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। কুরআনে এটিকে মা ও সন্তানের মধ্যে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামি আইন অনুযায়ী, স্তন্যদানের মাধ্যমে দুধ আত্মীয়তা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যা পারিবারিক আইনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।[][] বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে স্তন্যদানের বিভিন্ন প্রথা রয়েছে।

কুরআন ও হাদিস

সম্পাদনা

কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে ইসলামে স্তন্যপানের নৈতিক ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে যেগুলো মূলত মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছিলো।[]:১০৬ কুরআন ২৮:৭ এবং কুরআন ২৮:১২ আয়াতে ইসলামি নবী মূসার দুধপানকে উল্লেখ করা হয়েছে, যা শিশু মূসা ও তার মায়ের মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধনকে তুলে ধরে।[]:১০৬ স্তন্যপানকে একটি মৌলিক মাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়েছে কুরআন ২২:২ আয়াতে, যেখানে সন্তানের দুধপান থেকে বিরত থাকা মায়ের আচরণকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[]:১০৬

কুরআনের মতে, স্তন্যপান প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার[] কুরআন ২:২৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে যদি কোনো সন্তানের মাকে প্রসবের আগে বা পরে তালাক দেওয়া হয়, এবং শিশুটি তখনও স্তন্যপান করে, তাহলে কুরআন অনুযায়ী, শিশুর বাবার উচিত স্তন্যপানকালীন সময়ে মায়ের জন্য খাদ্য ও পোশাকের ব্যবস্থা করা। তবে মা-বাবার পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে আগেই শিশুকে দুধ ছাড়ানো যেতে পারে।[]:১০৬ একই আয়াতে বলা হয়েছে যে, মায়ের দুধপানের বিকল্প হিসেবে দুগ্ধপোষিকার বা দুধমায়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।[]:১০৬ কুরআন ৬৫:৬–৭ আয়াত অনুসারে, সন্তানের পিতার উচিত দুগ্ধপোষিকার প্রতি উদার হওয়া।[]:৪৭৭

কুরআন রক্তের সম্পর্কের মতোই দুধমায়ের সম্পর্ককেও গুরুত্ব দেয়।[]:৪৭৭ তাই কুরআন ৪:২৩ আয়াতে একজন পুরুষের জন্য তার "দুধ-মা" বা "দুধ-বোনের" সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।[]:১০৭ হাদিস অনুযায়ী, দুধপোষিকার স্বামীও দুধের সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ একজন নারী তার দুধপোষিকার স্বামীকে বিয়ে করতে পারবে না।[]:৪৭৭

বিদ্বানদের মতে, এই বিধিনিষেধ ইহুদিখ্রিস্টান ধর্মে পাওয়া যায় না, তবে এটি মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত।[]:১০৭

ইসলামি আইনে

সম্পাদনা

ইসলামি আইনে স্তন্যপানকে শিশুদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[] মুসলিম আইনজ্ঞরা এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, আল-মাওয়ার্দী (মৃত্যু ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ) স্তন্যপান বিষয়ে "কিতাব আল-রাদা" নামে পুরো একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন; এতে স্তন্যপান সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।[] এতে শিশুর স্তন্যপানের অধিকার এবং দুধমায়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

স্তন্যপানের অধিকার

সম্পাদনা

মায়ের দুধ পানের অধিকার ইসলামি আইনে শিশুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়।[] যদি মা শিশুকে স্তন্যপান করাতে অসমর্থ হন, তবে পিতার দায়িত্ব হলো একজন দুগ্ধপোষিকা নিয়োগ করা এবং তার পারিশ্রমিক প্রদান করা।[] যদি শিশুর পিতা-মাতা তালাকপ্রাপ্ত হন, তবে স্তন্যপানকালীন সময়ে শিশুর মাকে তার প্রাপ্য ভরণপোষণ বাবদ অর্থ প্রদান করতে হবে।[] জাফরি মাজহাবের অনুসারীরা আরও মনে করেন যে, স্বামী-স্ত্রী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও স্তন্যপানের জন্য মায়ের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে।[] তবে সুন্নি মাজহাবের পণ্ডিতরা একমত নন এবং তারা মনে করেন, যদি স্বামী-স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত হন, তবে স্বামীর পক্ষে স্তন্যদানের জন্য স্ত্রীকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান বাধ্যতামূলক নয়;[] কারণ ইসলামি আইনে স্ত্রী ইতোমধ্যে তার ভরণপোষণ (খাদ্য ও বস্ত্র) পাওয়ার অধিকার রাখেন।[]

কিছু মত অনুযায়ী, একজন মায়ের তার সন্তানকে স্তন্যদানের অধিকার রয়েছে, তবে তিনি চাইলে এটি না করার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন।[] এটি ইসলামি আইনের সাধারণ নীতির একটি সম্প্রসারণ, যেখানে সন্তানকে লালন-পালন করার অধিকার রয়েছে মায়ের, তবে এটি তার জন্য দায়িত্ব নয়, তাই তিনি চাইলে এই অধিকার ত্যাগ করতে পারেন।[]

রমজানে স্তন্যপান

সম্পাদনা

যদি কোনো নারী স্তন্যপান করান, তবে তার জন্য রমজানে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। তবে তিনি চাইলে রোজা রাখতে পারেন। রোজা রাখা স্তন্যপানের ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।[]

শিশুদের জন্য দুধমা

সম্পাদনা

কুরআনের দৃষ্টিতে স্তন্যপান দুধমায়ের সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যা বিবাহের বিধানের ওপর প্রভাব ফেলে।

ইসলামি ফিকহে এই সম্পর্কের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে, যেখানে নির্ধারন করা হয়েছে কোন কোন আত্মীয়তার ক্ষেত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। শিয়া ইসলামে কুরআনের বিধান অনুসারে, দুধ-মাতার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সঙ্গেও বিবাহ নিষিদ্ধ। শিয়া সমাজে সাধারণত দুগ্ধপোষিকা নারীরা নিম্ন শ্রেণির মানুষদের মধ্যে থেকে আসতেন, ফলে তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাহের সম্ভাবনা ছিল কম। বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে হাম্বলী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইবনে হাম্বলও এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন।[১০]

দুধমা সম্পর্ক তৈরির জন্য ন্যূনতম কতবার স্তন্যপান করানো প্রয়োজন, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। প্রাচীন মাজহাবগুলোর অনুসারীদের মধ্যে যেমন মালিকিহানাফিরা মনে করেন, একবার স্তন্যপানই দুধমা সম্পর্ক তৈরির জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে, শাফিঈ মাজহাবের অনুসারীরা মনে করেন, কমপক্ষে পাঁচ বা দশবার স্তন্যপান করানো আবশ্যক। তারা যুক্তি দেন যে, এক সময় কুরআনের একটি আয়াতে এই সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, যদিও পরে সেটি নাসখ (বাতিল) হয়ে যায়, তবে বিধানটি কার্যকর থাকে। তবে ইমাম মালিক বিশ্বাস করতেন যে, শুধু বাক্যাংশই নয়, বিধানটিও নাসখ হয়ে গেছে।[১১][১২]

প্রাপ্তবয়স্কদের স্তন্যপান

সম্পাদনা

নিম্নলিখিত বর্ণনায় (হাদিস) এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বিশেষ করে রদাʿ আল-কবীর বা প্রাপ্তবয়স্কের স্তন্যপান এবং স্তন্যপানের সংখ্যা সম্পর্কিত বিধান:

উরওয়া ইবনে যুবায়ের বর্ণনা করেন যে, নবী (সা.) আবু হুজাইফার স্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি তার স্বামীর মাওলা [অর্থাৎ দাস] সালিমকে স্তন্যপান করাবেন, যাতে সে তাদের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও বসবাস করতে পারে।[১৩][১৪][১৫][১৬]

বেশিরভাগ ফকিহদের মতে (ইবনে হাজম এর ব্যতিক্রম), দুধ আত্মীয়তার বিধান কেবল তখনই কার্যকর হয় যখন শিশুটি স্তন্যপানকালীন সময়ে থাকে। তবে, এসব ফকিহও স্বীকার করেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় স্তন্যপান করানোর ফলে একটি নতুন সম্পর্ক গঠিত হয়; উদাহরণস্বরূপ, ইবনে রুশদ রায় দেন যে, এই কারণে ঐ নারী এখন সেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সামনে কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন, যেমন হিজাব ছাড়া উপস্থিত হওয়া।[১৭]

বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ মুহাম্মাদ আল-বুখারি একবার ফতোয়া দেন যে, দুটি শিশু যদি একই গৃহপালিত প্রাণীর দুধ পান করে, তবে তারা দুধ ভাইবোন হয়ে যাবে। এর ফলে, তিনি বুখারা শহরের মুফতির পদ থেকে অপসারিত হন এবং শহর ছাড়তে বাধ্য হন।[১৮]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. (Giladi 1999, পৃ. 69)
  2. G. J. H. van Gelder, Close Relationships: Incest and Inbreeding in Classical Arabic Literature, আইএসবিএন ১-৮৫০৪৩-৮৫৫-২, p. 93
  3. Giladi, Avner। "Lactation"। Jane Dammen McAuliffe। Encyclopaedia of the Quran3। পৃষ্ঠা 106–107। 
  4. Benaouda Bensaid (২০১৯)। "Breastfeeding as a Fundamental Islamic Human Right"। Journal of Religion and Health 
  5. Giladi, Avner। "Wet-nursing"। Jane Dammen McAuliffe। Encyclopaedia of the Quran5। পৃষ্ঠা 476–77। 
  6. Jamal Nasir (১৯৯০)। The Islamic Law of Personal Status। পৃষ্ঠা 172। 
  7. Vincent J. Cornell, সম্পাদক (২০০৭)। Voices of Islam: Voices of tradition1। Praeger। পৃষ্ঠা 86। 
  8. Ronak Husni, Daniel L. Newman (২০০৭)। Muslim Women in Law and SocietyTaylor & Francis। পৃষ্ঠা 59। 
  9. "Advice for pregnant and breastfeeding women before fasting in Ramadan"hamad.qa। সংগ্রহের তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ 
  10. (Giladi 1999, পৃ. 70)
  11. John Burton, The Sources of Islamic Law: Islamic Theories of Abrogation, আইএসবিএন ০-৭৪৮৬-০১০৮-২, pp. 156–158
  12. Burton, নাসখ, Encyclopaedia of Islam
  13. John Burton, The Sources of Islamic Law: Islamic Theories of Abrogation, pp. 157
  14. "Hadith - The Book of Suckling - Sahih Muslim - Sunnah.com - Sayings and Teachings of Prophet Muhammad (صلى الله عليه و سلم)"sunnah.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৪ 
  15. "Hadith - The Book of Suckling - Sahih Muslim - Sunnah.com - Sayings and Teachings of Prophet Muhammad (صلى الله عليه و سلم)"sunnah.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-২৪ 
  16. "قصة سالم ورضاعه من السيدة سهلة"। ২৪ জুলাই ২০২১। 
  17. (Giladi 1999, পৃ. 86)
  18. Giladi, Infants, Parents and Wet Nurses, p. 69