ইসলামি বৈবাহিক আইনশাস্ত্র

বিবাহের আরবি শব্দ হলো নিকাহ। নিকাহ এর শাব্দিক অর্থ হলো, একত্রিত হওয়া, নারী পুরুষ মিলিত হওয়া। পারিভাষিক অর্থে নিকাহ বা বিবাহ বলা হয়। ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ হল একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে নিষ্পন্ন বৈধ বন্ধন ও সামাজিক চুক্তি । ইসলামে বিবাহ হল একটি সুন্নাহ বা মুহাম্মাদ এর আদর্শ এবং ইসলামে বিবাহ করার জন্য অত্যন্ত জোরালোভাবে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।[১][২] পাশাপাশি, ইসলামে সন্ন্যাসজীবন এবং কৌমার্যেরও কঠোর বিরোধিতা করা হয়েছে।[২] একজন ব্যক্তি তখনই বিবাহের বয়সী হবে, যখন সে মানসিক, দৈহিক ও আর্থিকভাবে বৈবাহিক জীবন নির্বাহ করতে সমর্থ হবে । বিশেষ শর্তসাপেক্ষে পুরুষের বহুবিবাহের জন্য ইসলামে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে নারীর বহুবিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا

অর্থ: “হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক উৎস থেকে। আর তা থেকে তোমাদের স্ত্রীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। এরপর তা থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।” (সূরা নিসা, আয়াত ০১)

“পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে।” (সুরা নিসা: ৩৪)

ইসলামী শরীয়ত অনুসারে বিবাহের রুকন বা মূল স্তম্ভ হচ্ছে দু’টি। ১.ইজাব তথা প্রস্তাব, ২.কবুল, বা গ্রহণ। এর জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে সাক্ষী থাকা।

বিবাহের ধরনসমূহ সম্পাদনা

নিকাহ সম্পাদনা

নিকাহ মুতা'হ সম্পাদনা

বিবাহের সীমারেখাসমূহ সম্পাদনা

যাদের বিবাহ করা হারাম (নিষিদ্ধ) সম্পাদনা

কুরআনের আলোকে যাদের সঙ্গে বিবাহ হারাম তারা হলেন:

আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকন্যা, ভগিনীকন্যা, তোমাদের সে মাতা যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সঙ্গে সহবাস করেছ, সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সঙ্গে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই, তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু। এবং অন্যের বৈধ স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম।

যে সমস্ত মহিলাদেরকে বিবাহ করা হারাম তাদেরকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ মহিলা: তারা তিন শ্রেণীর।

ক.বংশগত কারণে নিষিদ্ধ: তারা হলেন-

১. মাতা

২. দাদী

৩. নানী

৪. নিজের মেয়ে, ছেলের মেয়ে, মেয়ের মেয়ে যত নিচেই যাক না কেন।

৫. আপন বোন, বৈমাত্রেয় বোন ও বৈপিত্রেয় বোন।

৬. নিজের ফুফু, পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা ও নানীর ফুফু।

৭. নিজের খালা, পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা ও নানীর খালা।

৮. আপন ভাই, বৈমাত্রেয় ভাই ও বৈপিত্রেয় ভাই ও তাদের অধঃতন ছেলেদের কন্যা।

৯. আপন বোন, বৈমাত্রেয় বোন ও বৈপিত্রেয় বোন ও তাদের অধঃতন মেয়েদের কন্যা।

খ. দুগ্ধ সম্বন্ধীয় কারণে নিষিদ্ধ:

বংশগত কারণে যাদেরকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ দুগ্ধ সম্বন্ধের কারণেও তারা নিষিদ্ধ। তবে, শর্ত হচ্ছে-

দুই বছরের আগেই স্তন্য পান করা। দুই বছর বয়সের পর স্তন্য পান করলে স্তন্যদানকারীনির সঙ্গে তার দুগ্ধ সম্পর্ক সৃষ্টি হবে না।

গ. বৈবাহিক সম্বন্ধের কারণে নিষিদ্ধ:

১. পিতা, দাদা ও নানা (যতই উপরে যাক না কেন) যাদেরকে বিবাহ করেছেন।

২. কোন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক উক্ত পুরুষের পুত্র-পোত্র বা প্রপোত্রের সঙ্গে মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ।

৩. কোন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক উক্ত পুরুষের পিতা-দাদা বা নানার সঙ্গে মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ।

৪. শাশুড়ী। মহিলার সঙ্গে বিবাহ হলেই তার মাতা ও দাদী বা নানী হারাম হয়ে যাবে। দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক।

৫. স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেই তার কন্যা, তার পুত্রের কন্যা ইত্যদি হারাম হয়ে যাবে।

সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ মহিলা:

সাময়িক কারণে কখনো কখনো মহিলাকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ হয়ে থাকে। উক্ত কারণ দূর হয়ে গেলে তাকে বিবাহ করা বৈধ হবে।

১. কোন মহিলাকে বিবাহ করলেই তার আপন বোন, ফুফু, খালাকে বিবাহ করা হারাম গণ্য হবে। তবে, তাকে যখন তালাক দিয়ে দেবে কিংবা, স্বামী মারা যাবে এবং সে ইদ্দত শেষ করবে, তখন তাকে সে বিবাহ করতে পারবে।

২. যে মহিলা অন্যের বিবাহাধীনে ছিল। তাকে স্বামী তালাক দিয়েছে কিংবা মারা গেছে এবং সে ইদ্দত পালন করছে; এমতাবস্থায় তাকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। ইদ্দত শেষ হয়ে গেলেই বিবাহ করতে পারবে।

বহুবিবাহ সম্পাদনা

ইসলাম আসলে পুরুষদের অসংখ্য বিয়ের সুযোগ রহিত করে দিয়েছে। ইসলাম বিবাহ বিমুখ সমাজে এসে লোকদেরকে পাইকারী হারে চারটি করে বিয়ের নির্দেশ দেয় নি, বরং নারীদের যথেচ্ছ ব্যবহারে উন্মুখ সমাজে পুরুষদের শতাধিক বিয়ের ক্ষমতাকে রহিত করে দিয়ে তাকে সর্বোচ্চ চারটির মধ্যে স্থির করে দিয়েছে। ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে নারীদেরকে যথেচ্ছা ব্যবহার করা হতো। এক একজন ব্যক্তির স্ত্রীদের কোন সীমা রেখা ছিলো না। শুধু মুসলমান নয় অন্যান্য ধর্মের অনুসারি সহ অনেকের স্ত্রীদের সংখ্যা ছিলো ১০০ (একশত) এরও বেশি। ১০/১৫ টি ছিলো সাধারণ বিষয়।

ইসলাম পুরুষদেরকে একাধিক তথা চারটি বিয়ের ‘নির্দেশ’ দেয়নি, বরং প্রয়োজনীয় শর্ত সাপেক্ষে ‘অনুমতি’ দিয়েছে। যদি শর্ত পূরণ করা না যায়, তাহলে একটির অধিক বিবাহ করাকেও হারাম বলেছে

ইরশাদ হয়েছে,

"তোমরা বিয়ে কর নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে; দু’টি, তিনটি অথবা চারটি। আর যদি ভয় কর যে, তোমরা সমান আচরণ করতে পারবে না, তবে একটি।"(সূরা নিসা, আয়াত ৩)

অনুমোদিত বয়স সম্পাদনা

ইসলামে বিবাহের জন্য কোনো বয়সের সীমারেখা নেই, বরের ক্ষেত্রে মনোদৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্য তৈরি হলে এবং কনের ক্ষেত্রে অভিভাবকের উপস্থিতিতে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী সকল বয়সে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া বৈধ । তবে বিবাহের পরেও দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়েরই শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ও পরিপক্ব হওয়া আবশ্যক ।

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পারস্পারিক সমতা (কুফু) সম্পাদনা

কাফাহ বা কুফু (আরবি: الكفاءة; আল-কাফ'আ) হল ইসলামে বিয়ের ব্যাপারে ইসলামী আইনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি শব্দ, যার আরবি ভাষায় আক্ষরিক অর্থ, সমতা বা সমতা। এইভাবে এটি একটি সম্ভাব্য স্বামী এবং তার সম্ভাব্য স্ত্রীর মধ্যে সামঞ্জস্য বা সমতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা মেনে চলতে হবে।এই সামঞ্জস্য ধর্ম, সামাজিক মর্যাদা, নৈতিকতা, ধার্মিকতা, সম্পদ, বংশ বা রীতিনীতির অন্তর্ভুক্ত একাধিক কারণের উপর নির্ভরশীল।

মোহরানা সম্পাদনা

ইসলামে, মহর বা মোহর হল বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পিতার পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়| মোহরানা ধার্য করা ওয়াজিব। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক| মহরের মাধ্যমেই পূর্ণাঙ্গ বিয়েকে বৈধ করা হয়| প্রাচীন আরবে যৌতুক দেয়ার প্রথা চালু ছিল, নবুয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে যৌতুক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে আবশ্যক দেনমহরপ্রথা চালু করেন| ইসলামে মহরের কোন সীমারেখা নেই| মোহর বাকি না রেখে যথাসাধ্য আদায় করতে বলা হয়েছে, যেন কনের মহর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়|

যদি মহরানা ধার্য না করে বিয়ে করে ফেলে তারপরও স্ত্রীকে মহরানা দিতে হবে। এটা কোন মতেই বাদ দেয়া যাবে না। এসম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে:

“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সুরা নিসা: ৪)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

“তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না, যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মোহর প্রদান কর।” (সুরা মুমতাহিনা: ১০)

ওয়ালিমা সম্পাদনা

ওয়লিমা হচ্ছে বিয়ের পরের দিন বরের বাড়িতে বরের সাধ্য অনুযায়ী অনুষ্ঠান করা। হযরত মুহাম্মদ (সা) কোন বিয়েতে ওয়ালিমা করে অনেক মানুষকে খাইয়েছিলেন। আবার কোন বিয়েতে অল্প পরিসরে অনুষ্ঠান করেছিলেন।

বিবাহের অন্তর্গত আচরণসমূহ সম্পাদনা

যৌন অধিকার সম্পাদনা

অন্যান্য শর্ত পূরণ হলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌনসঙ্গম হওয়ার পরই বিবাহ পরিপূর্ণ হয়। বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল যৌনসম্পর্ক, যেখানে কিছু বিধিনিষেধ ব্যতীত পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা