ইরানে ইঙ্গ–সোভিয়েত আক্রমণ

ইরানে ইঙ্গ–সোভিয়েত আক্রমণ বা অপারেশন কাউন্টেন্যান্স বলতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যঅস্ট্রেলিয়া কর্তৃক ইরানের ওপর পরিচালিত আক্রমণকে বুঝানো হয়। আক্রমণটি ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হয়। ইরানের তেলক্ষেত্রসমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য মিত্রশক্তির রসদ সরবরাহের পথ সুরক্ষিত করাই ছিল এই আক্রমণের উদ্দেশ্য। যদিও ইরান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল, তবুও মিত্রশক্তি ইরানের শাহ রেজা শাহকে অক্ষশক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করছিল এবং ইরান আক্রমণ ও দখলের পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ রেজাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল।

ইরানে ইঙ্গ–সোভিয়েত আক্রমণ
অপারেশন কাউন্টেন্যান্স
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্য ফ্রন্ট

তাব্রিজের রাস্তায় চলমান টি-২৬ হালকা ট্যাঙ্কে আসীন সোভিয়েত ৬ষ্ঠ ট্যাঙ্ক ডিভিশনের সৈন্যরা
তারিখ২৫ আগস্ট – ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪১
অবস্থান
ফলাফল

মিত্রশক্তির বিজয়

অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর ইরান দখল করে
যুক্তরাজ্য দক্ষিণ ইরান দখল করে
বিবাদমান পক্ষ

সোভিয়েত ইউনিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন
যুক্তরাজ্য যুক্তরাজ্য

অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রেলিয়া
ইরান
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
সোভিয়েত ইউনিয়ন জোসেফ স্ট্যালিন
সোভিয়েত ইউনিয়ন দিমিত্রি কজলভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন সের্গেই ত্রোফিমেঙ্কো
যুক্তরাজ্য উইনস্টন চার্চিল
যুক্তরাজ্য এডওয়ার্ড কুইনান
যুক্তরাজ্য উইলিয়াম স্লিম
রেজা শাহ
আলী মনসুর
মোহাম্মদ-আলী ফারুঘি
গোলাম-আলী বায়ান্দর  
শক্তি
সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩টি আর্মি
যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়া ২টি ডিভিশন
৩টি ব্রিগেড
৪টি ক্ষুদ্র জাহাজ
১টি গানবোট
১টি রণতরী
১টি সশস্ত্র বাণিজ্যিক ক্রুজার
১টি সশস্ত্র ইয়ট
৯টি ডিভিশন
৬০টি বিমান
২টি ক্ষুদ্র জাহাজ
৪টি প্যাট্রোল বোট
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
সোভিয়েত ইউনিয়ন ৪০ সৈন্য নিহত
৩টি বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত
যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়া ২২ সৈন্য নিহত[১]
৫০ সৈন্য আহত[১]
১টি ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত
~৮০০ সৈন্য নিহত
৬টি বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত
২টি ক্ষুদ্র জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত
২টি প্যাট্রোল বোট বাজেয়াপ্ত
২১৩+ ইরানি বেসামরিক নাগরিক নিহত

আক্রমণ সম্পাদনা

উত্তর–পশ্চিম ইরানে সোভিয়েত আক্রমণ সম্পাদনা

ইরানি আজারবাইজানে সোভিয়েত আক্রমণ সম্পাদনা

 
১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত প্রহরীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরবরাহ কনভয়

২৫ আগস্ট সোভিয়েত বাহিনী আক্রমণ চালায় এবং সোভিয়েত বিমান হামলায় ইরানি বিমানঘাঁটিসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়। সোভিয়েতরা ১,০০০টির বেশি ট্যাঙ্ক এবং মোটরবাহিত পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করে তিনটি আর্মার্ড স্পিয়ারহেডে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালায়। ঐ অঞ্চলে ইরানিদের কোনো ট্যাঙ্ক ছিল না। সোভিয়েত ৪৭তম আর্মি নিয়ে গঠিত প্রথম বাহিনীটি সীমান্ত অতিক্রম করে সোভিয়েত আজারবাইজান থেকে ইরানি আজারবাইজানে প্রবেশ করে। বাহিনীটি তাব্রিজ এবং উর্মিয়া হ্রদের দিকে অগ্রসর হয়। তারা ইরানের জোলফা শহরটি দখল করে নেয়। একটি ইরানি অনুসন্ধানকারী বিমান জোলফার দক্ষিণে সোভিয়েত বাহিনীকে মালান্দের দিকে অগ্রসর হতে দেখতে পায়।

জেনারেল মাৎবুদির নেতৃত্বাধীন ইরানি ৩য় ডিভিশনের পক্ষে শিবলির দিকে মোটরবাহিত পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করে সোভিয়েত অগ্রগতি থামানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আক্রমণের আকস্মিকতার কারণে তিনি সঠিকভাবে প্রতি-আক্রমণ করতে ব্যর্থ হন। তিনি বিস্ফোরক ব্যবহার করে ঐ অঞ্চলের সেতু ও রাজপথগুলো ধ্বংস করে দিতেও ব্যর্থ হন, যার ফলে সোভিয়েতরা অঞ্চলটি জুড়ে দ্রুতগতিতে চলাচলের সুযোগ লাভ করে। জোলফার আশেপাশে ৫টি ইরানি বোমারু বিমান সোভিয়েত সৈন্যদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

 
১৯৪১ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ সৈন্যরা একটি সোভিয়েত টি-২৬ ট্যাঙ্ক পরিদর্শন করছে

সোভিয়েত ৫৩তম আর্মি সীমান্ত অতিক্রম করে আরদাবিল শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাদেরির নেতৃত্বে ইরানের ২৫তম ডিভিশন শহরটি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। দুইটি ইরানি রেজিমেন্ট সোভিয়েতদের মোকাবেলা করার জন্য নির শহরের দিকে অগ্রসর হয়। একটি সুগঠিত বাহিনী এবং নিবেদিত সৈন্য থাকা সত্ত্বেও কাদেরি নিজের গাড়িতে আশ্রয় নেন এবং সৈন্যদের পরিত্যাগ করেন। রসদবাহী ট্রাকগুলোতে নিজের ব্যক্তিগত সামগ্রী তোলার জন্য সৈন্যদের খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র ও কামান অপসারণের নির্দেশ দিয়ে তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আরো অন্তর্ঘাত ঘটান[২]। সোভিয়েতরা নির শহরকে পাশ কাটিয়ে যায় এবং দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। সোভিয়েত বিমানবাহিনী আরদাবিলে বোমাবর্ষণ করে এবং এতে সেখানকার সেনানিবাসের সামান্য ক্ষতি হয়। বিচ্ছিন্ন এবং পাশ কাটানো অবস্থায় আরদাবিলে ইরানের ১৫তম ডিভিশন এবং তাব্রিজে ইরানের ৩য় ডিভিশন বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এরপরও নিয়মিত সৈন্যরা শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং বহু কমান্ডারকে ছাড়াই শত্রুবাহিনীর দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু খাদ্য, রসদপত্র ও গোলাবারুদের অভাবজনিত কারণে সৈন্যরা তাদের অধিকাংশ ভারী সামরিক সরঞ্জাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। স্থানে স্থানে কঠোর প্রতিরোধ চলতে থাকে এবং কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করে। কিন্তু ২৬ আগস্টের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী তাদেরকে পরাজিত করে এবং তাব্রিজ ও আরদাবিলসহ সমগ্র ইরানি আজারবাইজান দখল করে নেয়।

গিলানে সোভিয়েত আক্রমণ সম্পাদনা

২৫ আগস্টে সোভিয়েত কাস্পিয়ান সাগরীয় নৌবহর কর্তৃক গিলান প্রদেশে আক্রমণের মধ্য দিয়ে গিলানে সোভিয়েত আক্রমণ শুরু হয়। কাস্পিয়ান সাগরীয় নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল সেদেলনিকোভ এবং নৌবহরটিতে ১২টির বেশি প্যাট্রোল বোট, ডেস্ট্রয়ার, মাল্টিপল অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট বার্জ ও ল্যান্ডিং ক্রাফট ছিল। এর বিরুদ্ধে ৩টি ইরানি গানবোট অগ্রসর হয়। ইতোমধ্যে সোভিয়েত ৪৪তম আর্মি সীমান্ত অতিক্রম করে গিলানের অভ্যন্তরের দিকে অগ্রসর হয়। তারা আস্তারা রাজপথ এবং প্রধান উপকূলীয় রাজপথ (জাদেহ-ই-শোমাল) ধরে অগ্রসর হয়। এই অঞ্চলে প্রচুর ইরানি সৈন্য থাকা সত্ত্বেও অবতরণকৃত সোভিয়েত নৌ-সৈন্যদল কতিপয় ইরানি শহর দখল করে এবং স্থলবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সোভিয়েত নৌবহর থেকে অবতরণকৃত সৈন্যরা দ্রুত সীমান্ত শহর আস্তারা দখল করে নেয়। এরপর তারা পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। এই আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরানের কাস্পিয়ান সাগরীয় সমুদ্ররবন্দর বন্দর পাহলভী দখল করা। জেনারেল ইরানপুরের নেতৃত্বাধীন গিলানে অবস্থানরত ইরানি বাহিনী প্রাদেশিক রাজধানী রেশত এবং বন্দর পাহলভীতে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Compton Mackenzie, Eastern Epic, p.136
  2. Stone, Stone &। "War Diary Records for Invasion of Iran 1941"