আন্দীয় সভ্যতা

(ইনকা সভ্যতা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা হলো দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালা। এই পার্বত্য ভূভাগে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল, যাদের মধ্যে কতগুলি হল অতি প্রাচীন। সম্মিলিতভাবে এসব সভ্যতাকেই মূলত আন্দীয় সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। উত্তরে আজকের কলম্বিয়া থেকে দক্ষিণে আতাকামা মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূভাগে এই সভ্যতাগুলির বিকাশ ও বিস্তৃতির সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে আজকের পেরু ছিল এইসব প্রাচীন সভ্যতার বিকাশের কেন্দ্রভূমি।[১][২] অবশ্য তার বাইরেও তিওয়ানাকু, প্রভৃতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার অস্তিত্বর কথাও আমরা জানতে পারি।

নাসার তোলা ছবি, আন্দিজ বা আন্দেস পর্বতমালা - সুপ্রাচীন যুগ থেকে বহু সভ্যতার আঁতুড়ঘর

ইনকা সাম্রাজ্য ছিল পেরুর স্পেনীয় বিজয়ের পূর্বে এই অঞ্চলের প্রাচীন আমেরিন্ডিয়ান অধিবাসীদের শেষ স্বাধীন রাজনৈতিক অস্তিত্ব। এমনকী তাদের সাম্রাজ্যেও কিন্তু আমরা দেখতে পাই বহু জাতি, ভাষা ও সভ্যতার আলাদা আলাদা অস্তিত্ব বজায় ছিল। এরা যদিও সবাই ইনকাদের শাসনের অধীনেই ছিল, সকলের তাদের প্রতি সমান আনুগত্য ছিল না, সকলের সংস্কৃতিও একইরকম ছিল না। যেমন চিমুরা মুদ্রার ব্যবহার করতো, কিন্তু ইনকা সাম্রাজ্যে তার ব্যবহার ছিল না। সেখানে বিনিময় প্রথার মাধ্যমেই বাণিজ্য চলতো। আবার চাচাপোয়ারা ইনকাদের অধীনতা মানতে বাধ্য হলেও বাস্তবে তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্নই রয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই স্পেনীয়দের সাথে তাদের লড়াই শুরু হলে চাচাপোয়া অভিজাতদের এক বড় অংশ ইনকাদের পরিবর্তে স্পেনীয়দেরই সাহায্য করে।[৩]

১৫২০'র দশকের শেষের দিকে এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আবির্ভাব[৪][৫] ও তারপর থেকে তাদের উপনিবেশের ক্রমাগত বিস্তারের ফলে এই অঞ্চলে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, তার ফলেই এই অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে ও ইউরোপীয় ধারার সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে শুরু করে।[৪]

প্রাক-কলম্বীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতা সম্পাদনা

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার সমগ্র আমেরিকার ইতিহাসেই ধারাবাহিকতার মাঝে এক ছেদ'এর কাজ করেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ অঞ্চলও তার ব্যতিক্রম নয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের পদার্পণ এতটাই প্রভাববিস্তার করে যে তার আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষের সভ্যতার সুদীর্ঘ ধারা এর ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। বহুক্ষেত্রে ভাষা সংস্কৃতি থেকে পুরো জাতি পর্যন্ত এর ধাক্কায় বিলুপ্ত হয়, বা তাদের আগেকার সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। ফলে আজ যখন ঐতিহাসিকরা আবার ঐ অঞ্চলের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন, দেখা গেছে স্পেনীয়দের আগমণের সময়ে মূলত স্পেনীয়দেরই লেখা কিছু বিবরণ ও স্পেনীয় ভাষা শিখে সেই ভাষাতেই লেখা আমেরিন্ডীয়দের অতি সামান্য কিছু বিবরণ ছাড়া তাদের হাতে আর বিশেষ কিছুই এসে পৌঁছয়নি। ফলে কলম্বাসের অভিযানের পূর্বের ইতিহাস উদ্ধারের ক্ষেত্রে মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সেই কারণেই আন্দীয় অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও কলম্বাস-পূর্ব প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতা ও স্পেনীয়দের আগমণের সমকালীন সভ্যতা এই দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করাই শ্রেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের ইতিহাসের উপকরণ তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই তার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাও তুলনায় অনেক বেশি বিস্তারিত।

কারাল সভ্যতা সম্পাদনা

 
প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে শুষ্ক সুপে উপত্যকায় ৫০০০ বছরের পুরনো দুটি কারাল পিরামিড।

কারাল সভ্যতা বা কারাল-সুপে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা বহু ক্ষেত্রে নর্তে চিকো সভ্যতা নামেও পরিচিত।[৬] প্রথম নামটি এসেছে পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে। এইস্থানেই এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তূপটি আবিস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলটি, যতদূর বোঝা গেছে, এই সভ্যতায় একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান বলেও বিবেচিত হত।[৭] অন্যদিকে পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্য ভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (স্পেনীয়, অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। তার থেকেই এই দ্বিতীয় নামটির সৃষ্টি। খ্রিস্টজন্মের ৯০০০ বছর আগেই এই সভ্যতার সূচনা হয়।[৮] তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ - ১৮০০ অব্দকে এই সভ্যতার সবচেয়ে বেশি বিকাশের সময় বলে মনে করা হয়।[৯] উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে এই সভ্যতার অন্তত ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত, প্রভৃতি স্থলে খননকার্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার প্রচূর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাথরে তৈরি সম্ভাব্য বড় বড় মন্দিরের উঁচু প্ল্যাটফর্ম, বসবাসের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, বেশ কিছু ঢিবি, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি, প্রভৃতি। তবে নব্যপ্রস্তর যুগের এই সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার জানা ছিল না। এমনকী মৃৎপাত্র তৈরি বা ব্যবহারের কোনও নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। কালের বিচারে এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়টি ছিল পুরনো পৃথিবীর সুমের সভ্যতার থেকে হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরে যে সময়ে পিরামিডগুলি নির্মাণ হয়, তার সমসাময়িক। পশ্চিম গোলার্ধের অপর প্রাচীন সভ্যতা কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকে এই সভ্যতা অন্তত ২০০০ বছর প্রাচীন।[১০]

পৃথকভাবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, পৃথিবীর এমন ছটি কেন্দ্রের অন্যতম ও আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো নগরসভ্যতা এই কারাল সভ্যতার কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে গেছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নদী। এদের ধার বরাবর প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু তারা চাষ করতো কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, মূলত তুলো। সেই তুলো দিয়ে মাছ ধরার জাল তৈরি করে সরবরাহ করা হত সমুদ্রতীরে অবস্থিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে। এই কেন্দ্রগুলিতে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের মূল খাদ্যদ্রব্য। জালের সাথে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ই ছিল সেই অর্থে এই সভ্যতার ভিত্তি। অবশ্য সঙ্কীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে কিছু ফল ও সব্জিচাষের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই ধরনের সভ্যতার অন্য কোনও প্রাচীন নিদর্শনের কথা এখনও পর্যন্ত জানা নেই।[১০]

আজ থেকে প্রায় ৩৮০০ বছর আগে ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতার পতন ঘটে বলে মনে করা হয়।

লাস ভেগাস সংস্কৃতি সম্পাদনা

দক্ষিণ আমেরিকার অন্য এক সুপ্রাচীন সংস্কৃতি হল লাস ভেগাস সংস্কৃতি। প্রাচীন এই সংস্কৃতির বিকাশকাল মোটামুটি ৮০০০ - ৪৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।[১১] তবে অত্যন্ত ছোট ছোট মূলত পরিবারকেন্দ্রিক উৎপাদনভিত্তিক এই সংস্কৃতি তখনও তেমন কোনও কেন্দ্রীয় প্রশাসন যতদূর সম্ভব গড়ে তুলতে পারেনি। এই কারণে সভ্যতা শব্দটির তুলনায় সংস্কৃতি শব্দটি এদের বর্ণনায় বেশি উপযুক্ত। নৃতত্ত্ববিদ কারেন ই স্টোটার্ট'এর মতে ইকুয়েডরের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলের জটিল জীববৈচিত্রের সাথে সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে এরা এদের বসতিগুলি গড়ে তুলেছিল।[১১] এই অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া প্রায় ৩১টি সুপ্রাচীন বসতির অবশেষ থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের রেডিওকার্বন পরীক্ষায় এদের বয়সের প্রাচীনত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে।[১২]

এখানকার মানুষ ছিল মূলত শিকারী ও সংগ্রাহক; তবে এরা মাছ ধরতে জানতো। পরবর্তীকালে আদিম পদ্ধতিতে চাষও শুরু করে এরা। কাঠ, বাঁশ, লম্বা ঘাস ও গাছের ছাল এরা নানা কাজে ব্যবহার করতো।[১৩] তবে মৃৎপাত্র তৈরির পদ্ধতি এদেরও জানা ছিল না।

এরা ছোট ছোট দলে বাস করতো। তবে আশেপাশের নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে এদের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় ৩০০০ বছরের মধ্যে এদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে খুব সামান্যই পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল।[১১] বর্তমান ইকুয়েডরের সান্তা এলেনা অঞ্চলের সুম্পাতে এদের সবচেয়ে বড় বসতিটি আবিস্কৃত হয়েছে।

চাভিন সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
চাভিন মৃৎপাত্র

এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়কাল মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় হাজার বছর ব্যাপী সময়কাল। এদের ভাষা আমাদের জানা নেই এবং যতদূর সম্ভব সেই ভাষা আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। তাই এরা নিজেরা নিজেদের কী বলতো সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারা যায় না।[১৪] আন্দিজ পর্বতের উপর প্রায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পেরুর চাভিন দে উয়ান্তার'এ এই সভ্যতার সব থেকে বড় কেন্দ্রটি আবিস্কৃত হয়েছে বলে, সেই জায়গার নাম অনুসারে তাদের চাভিন সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করা হয়। কারাল-সুপে সভ্যতার আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই সভ্যতাকেই দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা বলে মনে করা হত। আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এদের মূল কেন্দ্রগুলি অবস্থিত হলেও উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।[১৫]

 
সোনার নেকলেস, চাভিন সংস্কৃতি

পেরুর বর্তমান রাজধানী লিমার কাছে অবস্থিত এই চাভিন দে উয়ান্তার শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দ নাগাদ নির্মিত হয়। তবে তার আগেও এখানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই কেন্দ্রের মন্দিরটিকে চাভিন স্থাপত্যের একটি প্রধান নিদর্শন বলে মনে করা হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচূর বৃষ্টিপাত হয়। তাই বৃষ্টির জলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মন্দিরটিকে ঘিরে অত্যন্ত সুন্দর নিকাশী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। তাছাড়া মন্দির তৈরি করতে যে সাদা ও কালো পাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল, তা বয়ে আনা হয়েছিল দূর থেকে। এর থেকে এক ধরনের সাংগঠনিক ক্ষমতার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, যার থেকে বোঝা যায় চাভিনদের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী।[১৫] তবে তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে তেমন কিছুই আবিস্কৃত হয়নি। চাভিন দে উয়ান্তার ছিল মূলত একটি ধর্মীয় কেন্দ্র। তবে এর অবস্থান ছিল পার্বত্য ও উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগের রাস্তা ও উত্তর দক্ষিণে যোগাযোগের রাস্তার একরকম সংযোগস্থলে। সেই কারণে আন্দাজ করা হয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল।[১৬]

চাভিন সভ্যতা ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। এরা ভুট্টা, কিনোয়া, আলু, প্রভৃতি ফসলের চাষ করতো। চাষের জন্য জল সেচের বন্দোবস্তও ছিল। স্থানীয় পশু ইয়ামাকে তারা পোষ মানিয়েছিল। তাদের মাংস খাওয়া হত, পোশাক তৈরির জন্য তাদের লোম ব্যবহৃত হত, আবার মালবহনের কাজেও তাদের ব্যবহার করা হত।[১৫][১৭] পূর্ববর্তী কারাল সভ্যতার সাথে তাদের এক উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল, মৃৎপাত্রের ব্যবহার তারা জানতো। উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের ব্যবহৃত সুন্দর সুন্দর মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার থেকে তাদের শিল্পবোধের পরিচয় মেলে। এছাড়া মন্দিরগাত্রে ও দেওয়ালেও তারা খোদাই করে অনেক শিল্পকর্ম রচনা করেছিল। এগুলির সাথে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের যোগ ছিল বলে মনে করা হয়।[১৭] ধাতুবিদ্যাতেও তাদের যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে। ধাতু গলিয়ে তারা কাজ করতে জানতো। সোনার কাজেও তাদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।[১৫]

ভালদিভিয়া সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
বর্তমান ইকুয়েডরের মানচিত্রে ভালদিভিয়া-সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলির অবস্থান

চাভিন সংস্কৃতি যদি এক অর্থে কারাল-সুপে সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে থাকে, লাস ভেগাস সংস্কৃতির সরাসরি উত্তরাধিকার বর্তায় ভালদিভিয়া সংস্কৃতির উপর। তবে এই দুই প্রাচীন সংস্কৃতি সময়ের হিসেবে পরস্পর সরাসরি যুক্ত ছিল না, বরং একের বিলোপ ও অপরের উদ্ভবের মধ্যে প্রায় ৬০০ বছরের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান ইকুয়েডরের গুয়াইয়াস প্রদেশের সান্তা এলেনা উপদ্বীপের ভালদিভিয়া শহরের কাছে নব্যপ্রস্তরযুগীয় এই সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলি প্রথম আবিস্কৃত হয়েছিল বলে তার এই নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ - ১৮০০ অব্দের মধ্যে ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল বরাবর এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সেই হিসেবে এই সংস্কৃতি ছিল দক্ষিণে বিকশিত ও উন্নত কারাল সভ্যতারই সমসাময়িক। তবে কারাল সভ্যতার মতো এখানে কোনও বৃহৎ শহর গড়ে ওঠা বা জটিল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের তেমন নিদর্শন পাওয়া যায় না। গুয়াইয়াস, লস রিওস, মানাবি এবং এল ওরো প্রভৃতি প্রদেশে লা সেন্তিনেলা, লা লোরা, পুয়েব্লো নুয়েভো, সান ইসিদ্রো, সান পাবলো, প্রভৃতি স্থানে এই সভ্যতার প্রায় ১৫০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে।[১৮]

ইকুয়েডরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ এমিলিও এস্ত্রাদা ১৯৫৬ সালে প্রথম এই সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এরা মৃৎপাত্র তৈরি করতে জানতো; এদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলিতে প্রথমদিকে সুক্ষতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হলেও ক্রমে ক্রমে এরা এতে খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তৈরি এদের রঙীন, পালিশযুক্ত ও সুক্ষ কারুকার্যতে পরিপূর্ণ পাত্রগুলি তার সাক্ষ বহন করে। এদের জীবনযাত্রার মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও মৎসশিকার। ভুট্টা, কাসাভা, বিনস, স্কোয়াশ, তুলো, প্রভৃতি ছিল তাদের প্রধান ফসল। সমুদ্র উপকূল, খাঁড়ি ও নদী থেকে তারা মাছও ধরতো। তুলো থেকে তারা কাপড় তৈরি করতো।

ভালদিভিয়ার মানুষের থাকার জায়গারও একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। কোনও একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে সাধারণত বৃত্তাকারে বা উপবৃত্তাকারে বাড়িগুলিকে সাজিয়ে তাদের বসতিগুলি গড়ে উঠেছিল। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ভালদিভীয় বসতিটি প্রায় ১০ হেক্টর জমির উপর গড়ে উঠেছিল। সেখানে যতদূর সম্ভব প্রায় ৩০০ মানুষ বসবাস করতো। তাদের বাড়িগুলিও ছিল বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকার বা কিছুটা U-আকৃতির। এদের তৈরি ভেনাস মূর্তিগুলিও বিশেষভাবে বিখ্যাত। আরও উল্লেখ্য, এই মূর্তিগুলি প্রতিটিই আলাদা আলাদা ব্যক্তির - কোনও দেবীমূর্তি নয়। মূর্তিগুলি সাধারণত মাটি দিয়েই তৈরি হত।

পারাকাস ও টোপারা সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
পারাকাস বয়নশিল্পের নমুনা

বর্তমান পেরুর পশ্চিমে দীর্ঘ প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের দক্ষিণ অংশে পারাকাস উপদ্বীপ সংলগ্ন ইকা অঞ্চলে মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে বিকশিত যে সংস্কৃতির নজির পাওয়া যায়, তা পারাকাস সংস্কৃতি নামে পরিচিত। পারাকাস উপদ্বীপে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষগুলো থেকেই এই সংস্কৃতির মানুষের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতে পারা গেছে। ১৯২০'র দশকে বিখ্যাত পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ হুলিও তেলিও প্রথম এই সংস্কৃতির বিষয়ে অনুসন্ধান চালান।[১৯] বড় বড় কবরস্থানে একসাথে অনেক মৃতদেহর সৎকার করা, মৃতদেহকে মমি করে রাখা, জলসেচের জন্য কাটা খালের বিন্যাস, সোনা পিটিয়ে তৈরি অলঙ্কার ও মুখোশ, অবসিডিয়ান ছুরি, মৃৎপাত্র এবং উন্নত রঙীন ও জটিল বয়নশিল্প এই সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।[২০]

ইকা উপত্যকা অঞ্চলে পারাকাস সংস্কৃতির মানুষদের বসবাস কালেই যতদূর সম্ভব উত্তর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দ নাগাদ এক নতুন সংস্কৃতির মানুষদের ঐ উপত্যকায় আগমণ ঘটে। এরপর অন্তত এক প্রজন্ম বা তার কিছু বেশি সময়কাল পারাকাস উপদ্বীপ ও ইকা উপত্যকা, দুই অঞ্চলেই এই দুই সংস্কৃতির মানুষই পাশাপাশি বসবাস করতে থাকে। এই নতুন সংস্কৃতির মানুষদের টোপারা বলে অভিহিত করা হয়। পারাকাসটোপারা সংস্কৃতির মধ্যে মিশ্রণের ফলেই পরবর্তী নাজকা সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। পারাকাসদের সুক্ষ বয়নশিল্প ও মৃৎশিল্পের দক্ষতা এই নতুন সংস্কৃতিতেও গৃহীত হয়। যদিও পারাকাসদের বয়নশিল্পের যা কিছু নিদর্শন শুষ্ক উপকূল অঞ্চল থেকেই বেশি পাওয়া গেছে, সাম্প্রতিক গবেষণায় যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এই সংস্কৃতির মানুষদের আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতেও যাতায়াত ছিল। সেখানেও তারা বসতি স্থাপনও করেছিল।

নাজকা সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
নাজকা চিত্রিত মৃৎপাত্র - রঙের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

নাজকা সংস্কৃতি হল আন্দীয় অঞ্চলের আরেক সুপ্রাচীন সংস্কৃতি। মোটামুটি ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল এই সংস্কৃতির বিকাশের সময়। দক্ষিণ পেরুর শুষ্ক উপকূলে নাজকা শহরের কাছে রিও গ্রন্দে নদীর উপত্যকায় এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল বলে ঐ শহরের নামানুসারে একে নাজকা সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই সভ্যতায় আমরা সহজেই পূর্বসুরী পারাকাস সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা লক্ষ করে থাকি। কিছু কিছু পরিবর্তন সূচিত হলেও, এদের বয়নশিল্প, সূচিকর্ম বা মৃৎপাত্র অনেকটা একই প্রকার। এদের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল পুকুইয়োনাজকা রেখা। এর মধ্যে প্রথমটি হল মাটির নীচ দিয়ে জলসংবহনের এক বিশেষ পদ্ধতি, নাজকারা যার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ৩২টি পুকুইয়ো পাওয়া গেছে। আর দ্বিতীয়টির কারণে নাজকারা আজ পৃথিবী বিখ্যাত। এগুলি হল মাটির উপর টানা বিশাল বিশাল সরলরেখা এবং তার সমন্বয়ে অঙ্কিত জ্যামিতিক চিত্র ও নানা পশুপাখির ছবি। এগুলির বিশালত্ব সত্যিই ধারণা করা কঠিন। প্রায়শই রেখাগুলি মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত এবং এতটাই বড় যে আধুনিক যুগে হেলিকপ্টার বা বিমানের সাহায্যেই একমাত্র তার পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলা সম্ভব হওয়ার পর তাদের প্রকৃত চেহারা সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা গেছে।[২১] ড্রেসডেনের জার্মান গবেষিকা মারিয়া রাইখা এরকম ৫০টি চিত্র ও ১০০০টিরও বেশি রেখা আবিষ্কার করেছেন, যাদের কোনও কোনওটি এমনকী ২০ কিলোমিটার লম্বা।[২২][২৩][২৪]

নাজকাদের কোনও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাদের বসতিগুলি ছিল ছোট, কোনও শহরের চিহ্ন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নাজকা উপত্যকার নিম্নাংশে কাউয়াচি নামক স্থানে একটি মাটির ঢিবি ও পিরামিড পাওয়া গেছে, যতদূর সম্ভব যা ধর্মীয় কারণেই ব্যবহৃত হত। এখানে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও ভোজসভার চিহ্ন পাওয়া গেছে।

তাদের কৃষি ব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নত। মিষ্টি আলু, স্কোয়াশ, ভুটা, ম্যানিওক, প্রভৃতি ফসল তারা উৎপাদন করতো। চাষের জন্য সেচের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া তারা সমুদ্রে জালের সাহায্যে মাছও ধরতো। সিল মাছ শিকারেও তারা ছিল দক্ষ। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তাদের পতন শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই পতন মোটামুটি সম্পূর্ণ হয়। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে বারে বারে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঝড় তথা এল নিনো জনিত বন্যাকে অনেক সময়ই দায়ী করে থাকেন।[২৫]

মোচে সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
মোচে মৃৎপাত্র

মোচে সংস্কৃতি মোচিকা সংস্কৃতি, প্রাক-চিমু সংস্কৃতি, প্রভৃতি নামেও পরিচিত। পেরুর উত্তরাংশে সমুদ্রোপকূলে আজকের মোচেত্রুহিলিও শহরের কাছাকাছি অঞ্চলে মোটামুটি ১০০ - ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে এরাও রাজনৈতিকভাবে কোনও একটি রাষ্ট্র গঠন করে উঠতে পারেনি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকলেও তারা একটি সাধারণ সংস্কৃতির জন্ম দিতে সক্ষম হয়। এদের তৈরি অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ও বিশাল বিশাল স্থাপত্যর নিদর্শন আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। বিশেষ করে সুন্দর সুন্দর মৃৎপাত্র, সোনার কাজ, মূলত ইঁটের তৈরি বিশাল বিশাল স্থাপত্য বা উয়াকা এবং জটিল ও বিস্তৃত সেচব্যবস্থা মোচে সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।[২৬] এদের সংস্কৃতি বিকাশের সমগ্র যুগটিকে আধুনিক ঐতিহাসিকরা মোটামুটি তিনটি পৃথক উপযুগে ভাগ করে থাকেন - প্রাচীন মোচে সংস্কৃতি (১০০ - ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ), মধ্য মোচে সংস্কৃতি (৩০০ - ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) ও অন্তিম মোচে সংস্কৃতি (৫০০ - ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ)।[২৭]

এরা ছিল মূলত একটি কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। কৃষির প্রয়োজনেই এরা বিস্তীর্ণ একটি অঞ্চল জুড়ে জটিল সেচব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। তার জন্য এরা প্রয়োজনে নদীস্রোতকে ঘুরিয়ে দিয়ে হলেও ফসলের মাঠে জলের জোগান নিশ্চিত করে।[২৭][২৮] তবে এদের হস্তশিল্প সবচেয়ে বিখ্যাত। এদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য থেকে এদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। শিকার, মাছ ধরা থেকে শুরু করে মারপিট, এমনকী যৌনাচার পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের অত্যন্ত বাস্তবানুগ চিত্র সেখানে পাওয়া যায়। এদের তৈরি মূর্তিগুলির আরেকটি বিশেষত্ব হল সেগুলি বেশিরভাগই মনে হয় ব্যক্তিবিশেষের, কোনও দেবদেবীর নয়।[২৮]

মোচেদের তৈরি আরও দুটি জিনিস বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তাদের ইঁট নির্মিত বিশাল বিশাল উয়াকাগুলির রঙের ঔজ্জ্বল্য, কারুকার্য ও বিশালত্ব সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কিন্তু কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে, কিছুটা স্পেনীয় বিজয়ের সময়ে লুঠপাটের কারণে সেগুলি আজ অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অন্যদিকে তাদের তৈরি সোনা ও অন্য ধাতুর তৈরি শিল্পকর্মগুলি তাদের সুক্ষ্মতার জন্যই বিস্ময়উদ্রেককারী।[২৮] এরা দক্ষিণে ইকা উপত্যকার নাজকা সংস্কৃতির সমসাময়িক। এদের উদ্ভবের সাথে পূর্ববর্তী চাভিন সংস্কৃতির যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। ওয়ারিচিমুদের এদের উত্তরসূরী বলে সাধারণভাবে ঐতিহাসিকরা মতপ্রকাশ করে থাকেন।

তিওয়ানাকু সভ্যতা সম্পাদনা

 
তিওয়ানাকু পুরোহিতের মূর্তি

তিওয়ানাকু সভ্যতা (স্পেনীয়Tiahuanaco বা Tiahuanacu) হল প্রাক্‌-কলম্বীয় আমেরিকার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ার পশ্চিমাংশে এর বিকাশ ঘটেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এরা ছিল ইনকাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বসূরী। তিতিকাকা হ্রদ তীরবর্তী এই সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ থেকে পশ্চিমে দেসাখুয়াদেহো যাওয়ার রাস্তায় লা পাজ থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে তিওয়ানাকু নামক স্থানে। আন্দিজ পর্বতের সুউচ্চ আলতিপ্লানো উচ্চভূমিতে অবস্থিত এই অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২৬০০ ফুট বা ৪০০০ মিটার উঁচু। ১৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনীয় বিজেতা (কনকিস্তাদোর) পেদ্রো সিয়েজা দে লেওন ইনকাদের শক্তিকেন্দ্র কুলিয়াসুয়ু খুঁজে বের করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে তিওয়ানাকুতে এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে ফেলেন।[২৯] মনে করা হয় এই শহরই ছিল এই সভ্যতার প্রশাসনিক প্রধান শহর। অন্তত পাঁচশো বছর এই শহরকে কেন্দ্র করে এই সভ্যতার শাসনব্যবস্থা বজায় ছিল বলে মনে করা হয়। ২০০০ সাল থেকে এই শহর ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।[৩০]

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিওয়ানাকু শহর সংলগ্ন অঞ্চলে সুপ্রাচীন সময় থেকেই মানুষের বসতি স্থাপিত হয়েছিল। প্রথম দিকে এটি ছিল একটি ছোট্ট কৃষিভিত্তিক গ্রাম।[৩১] কিন্তু ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই অঞ্চল একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এরপর তাকে কেন্দ্র করেই একটি শক্তিশালী রাজ্যের বিস্তার ঘটে, তিওয়ানাকু যার প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৬০০ - ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সভ্যতা তার বিকাশের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছয় বলে মনে করা হয়।[২৯] এইসময় বর্তমান বলিভিয়ার পশ্চিম অংশ থেকে এই সভ্যতা পশ্চিমে দক্ষিণ পেরু, উত্তর চিলি, ও উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্তিনাতেও ছড়িয়ে পড়ে।

মূলত কৃষিকে ভিত্তি করেই এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। চাষের জন্য এরা তিতিকাকা হ্রদ সংলগ্ন নিচু জমির মধ্যে কিছু অংশ উঁচু করে কৃষিজমি তৈরি করে। এই উঁচু জমিগুলোর মাঝখানে কিছুটা জল বাঁধাই থেকে যায়। তার ফলে জমি যে জল পায়, তাতে দেখা গেছে এই ধরনের জমি অতি উচ্চ ফলনশীলে পরিণত হয়। আবার এই জলে একই সাথে মাছও চাষ করা যায়। আবার চারদিকের নিচু থেকে যাওয়া ডোবা জমি যাতায়াতের জন্য জলপথ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।[৩২] এই সভ্যতার স্থাপত্য শিল্পও সত্যিই চোখে পড়ারই মতো। তিওয়ানাকু শহরে নানা পর্যায়ে অসংখ্য নির্মাণকার্য চলেছিল। এদের মধ্যে বেশ কটির ধ্বংসস্তূপ আমাদের সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান হল একটি পিরামিড - আকাপানা, বারো ফুট উঁচু একটি সূর্যতোরণ, একটি তিনশো ফুট লম্বা বড় বড় দরজাসহ পাথরের পাঁচিল ঘেরা উঠোন - কালাসাসায়া, প্রভৃতি।[৩২]

একাদশ শতাব্দী নাগাদ এই সভ্যতার পতনের সূচনা ঘটে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেই তাদের শাসন ভেঙে পড়ে। তবে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে তাদের শহরগুলির ধ্বংসাবশেষ আজও ইনকা-পূর্ব আন্দীয় সভ্যতাগুলির উৎকর্ষের জাজ্জ্বল্যমান নিদর্শন হিসেবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।[৩০]

চাচাপোয়া সম্পাদনা

 
কুয়েলাপ দুর্গর ভগ্নাবশেষ ও চারপাশের দৃশ্য

চাচাপোয়ারা হল আন্দিজ পার্বত্যাঞ্চলের আরেক প্রাচীন জাতি। আন্দিজ পর্বতের পূর্ব ঢালে, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের বিপরীত দিকে, বর্তমান পেরুর আমাজন নদী সংলগ্ন আমাজোনাস অঞ্চলে তাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইনকাদের সাথে তাদের দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। বহু চেষ্টার পর অবশেষে স্পেনীয় আক্রমণের মাত্র বছর ষাটেক আগে ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ইনকারা তাদের নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়। চাচাপোয়া নামটিও তাদেরই দেওয়া, কেচুয়া ভাষায় যার মানে 'মেঘ-যোদ্ধা'। এই অঞ্চলে অতিবৃষ্টি অরণ্য (রেন ফরেস্ট) ও সবসময় আর্দ্র পরিবেশের জন্যই বোধহয় ইনকারা তাদের এমন নামে ডাকত।

তবে চাচাপোয়াদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য হাতে পাওয়া যায় না। কারণ তাদের সম্বন্ধে স্পেনীয় ও ইনকাদের রেখে যাওয়া প্রত্যক্ষ বিবরণ নিতান্তই স্বল্প। এইকারণেই তাদের উপর তথ্যর প্রয়োজনে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির উপরই বেশি নির্ভর করতে হয়। যাইহোক, তাদের সম্বন্ধে যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায়, তার অন্যতম হল স্পেনীয় বিজেতা ও ঐতিহাসিক পেদ্রো সিয়েজা দে লেওনের লেখা বর্ণনা। তিনি চাচাপোয়াদের সমগ্র আমেরিন্ডীয়দের মধ্যে সবচেয়ে ফরসা ও সুন্দর বলে উল্লেখ করেছেন।[৩৩] এর থেকে বোঝা যায় অন্য আন্দীয় জাতিগুলির থেকে এরা ছিল কিছুটা আলাদা। তবে পেরুর ইনস্তিতুতো দে আরকেওলখিয়া আমাজোনিকার প্রত্নতাত্ত্বিকরা চাচাপোয়াদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী পরীক্ষা করে অভিমত প্রকাশ করেন যে তারা সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমাজনীয় জাতিগুলির থেকে আন্দীয় জাতিগুলিরই বেশি কাছাকাছি ছিল।

যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে বুঝতে পারা যায়, ২০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকেই আন্দিজ পর্বতের পূর্বঢালের এই আমাজন অরণ্যাঞ্চলে মানুষের বসতি ছিল, চাচাপোয়াদের সংস্কৃতির বিকাশের সূচনাসময় হিসেবে সাধারণত ৭৫০ - ৮০০ খ্রিষ্টাব্দকেই ধরা হয়। এদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল একটি বিশাল দুর্গ - কুয়েলাপগ্রান পাহাতেন, পাহাড়ের চূড়ার উপর তৈরি আরেকটি দেওয়াল ঘেরা প্রাচীন বসতির ধ্বংসস্তূপ। দুটি জায়গাতেই সামরিক প্রয়োজনে নির্মাণের দিকটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে।[৩৪] মনে হয় উয়ারিদের (চাচাপোয়াদের সমসাময়িক এই সংস্কৃতি আন্দিজের ঠিক উলটো ঢালে এইসময় বিকাশ লাভ করেছিল ও পর্বতের উচ্চভূমি থেকে একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।) হাত থেকে প্রতিরক্ষার খাতিরেই তারা এগুলি, গড়ে তুলেছিল। এর থেকে তাদের 'যোদ্ধা' পরিচয়টিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও কুয়েলাপ'এর অদূরেই তাদের একটি কবরস্থান কারাহিয়াও আবিষ্কৃত হয়েছে।[৩৫] তবে পঞ্চদশ শতকে ইনকারা আন্দিজ পর্বত পেরিয়ে তার পূর্বঢালের দিকে অগ্রসর হলে, চাচাপোয়াদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা ইনকাদের হাতে পরাজিত হয়। তাদের একরকম জোর করেই দলে দলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। তাদের পরপর বিভিন্ন বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। এই কারণেই হয়তো স্পেনীয়রা যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, ইনকাদের বিরুদ্ধে বহুক্ষেত্রে চাচাপোয়ারা স্পেনীয়দেরই পক্ষাবলম্বন করে। যাইহোক, ১৫৪৭'এর পর চাচাপোয়াদের স্বাধীন অস্তিত্ব স্পেনীয় ঔপনিবেশিক সৈন্যদের হাতেই খর্বিত হয় ও পরবর্তী সময়ে প্রবল অত্যাচার, দারিদ্র ও মহামারীতে তাদের জনসংখ্যা প্রবলভাবে হ্রাস পায়।[৩৬]

ওয়ারি সভ্যতা সম্পাদনা

 
পিকিলিয়াক্তায় উয়ারিদের তৈরি রাস্তা

উয়ারি বা ওয়ারিরা (স্পেনীয়Huari, উচ্চারণ - উয়ারি) ৫০০ - ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে[৩৭] তাদের সভ্যতা তথা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সময়ের বিচারে এরা ছিল তিওয়ানাকুদের সমসাময়িক। এদের মূল কেন্দ্রটি ছিল দক্ষিণ পেরুতে বর্তমান আয়াকুচো শহরের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত উয়ারিতে। প্রাচীন এই শহরকে কেন্দ্র করে উপকূলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে শুরু করে আন্দিজ পর্বতের উচ্চস্থল পর্যন্ত তারা তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সংস্কৃতিগত দিক থেকে এরা ছিল কারাল সভ্যতার উত্তরাধিকারী ও পরবর্তীকালের ইনকাদের পূর্বসূরী। জলের প্রয়োজন মেটাতে ও সেচের প্রয়োজনে এরা বড় বড় খাল কাটে ও পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলে। এদের প্রধান ফসল ছিল আলুভুট্টা। এদের শহরগুলো ছিল প্রাচীর ঘেরা। তারমধ্যে বাড়িগুলো ছিল পরপর সাজানো। মাঝে সরু রাস্তা। তবে বড় বড় প্রাসাদ, চক, চোখ ধাঁধানো মন্দির বা পিরামিডের কোনও নিদর্শন তেমন পাওয়া যায়নি। এদের বিষয়ে আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই যে শহরগুলোর জোরদার সুরক্ষা ব্যবস্থা বলে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। অর্থাৎ, যুদ্ধবিগ্রহের তেমন প্রকোপ তাদের সহ্য করতে হয়নি।[৩৮]

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ঐতিহাসিকরা উপকূলীয় পেরুর ও মধ্য-কেন্দ্রীয় আন্দিজের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ভগ্নাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এদের মধ্যে 'উয়ারি' থেকে অনেকখানি উত্তরে চিকলায়োতে যে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষটি মাত্র ২০০৮ সালে খুঁজে পাওয়া গেছে, তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।[৩৯] এছাড়াও দক্ষিণ পেরুতে মোকাহুয়া অঞ্চলের পার্বত্য উচ্চভূমিতেও তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর চেরো বাউল আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের এই শহরটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এখানেই তারা তিওয়ানাকুদের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছিল ও দুই সভ্যতার মানুষ পাশাপাশি প্রায় কয়েকশো বছর বসবাসও করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের তেমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।[৪০] আবার দক্ষিণ-পূর্বে কুজকো থেকে তিতিকাকা হ্রদ যাওয়ার পথে আন্দিজ পর্বতের উপরে তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র পিকিলিয়াক্তা খুঁজে পাওয়া গেছে। এত দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা তাদের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, তাদের সাম্রাজ্য কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল।

৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকে উয়ারিদের পতনের আভাস পাওয়া যেতে শুরু করে। আর ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তাদের শহরগুলি হঠাৎই পরিত্যক্ত হয়। এর প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা এখনও পর্যন্ত একমত হতে পারেননি।

চিমু সভ্যতা সম্পাদনা

 
১১০০ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি[৪১] চিমু মৃৎপাত্র

উত্তর পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চিমোর অঞ্চলে বর্তমান ত্রুহিলিও শহরের কাছাকাছি এলাকায় চিমু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এর ঐতিহাসিক সময়কাল ছিল মোটামুটি ১২৫০ থেকে ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ। এরা মূলত ছিল উত্তর পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা। আন্দিজ পর্বত ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ, মাত্র ২০ থেকে ১০০ মাইল চওড়া, কিন্ত যথেষ্ট লম্বা এক ভূভাগকে তাদের সভ্যতার বিকাশস্থল বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে পরবর্তীকালে এদের প্রভাব যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। দক্ষিণে পেরুর বর্তমান রাজধানী লিমার কাছকাছি অঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তরে আজকের ইকুয়েডরের সীমানা পর্যন্ত অঞ্চলে এদের প্রভাবাধীন ছিল বলে জানতে পারা গেছে।[৪২] এদের মূল শহর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চান চান। চিমু সভ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশের সময় এই শহরে এক লক্ষাধিক মানুষ বাস করত বলে মনে করা হয়। সেই হিসেবে সমকালীন দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল এই চান চান[৪৩] শহরটিতে ইঁটের তৈরি বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়। ১৪৭০ সালে তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানের পতন ঘটে ও ইনকা সম্রাট তুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের এলাকা দখল করে তাকে ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আগমণের মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ঘটা এই যুদ্ধেই স্বাধীন রাজ্য হিসেবে চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে। সেই কারণেই স্পেনীয়রা যখন এখানে এসে পৌঁছয়, তখনও ইনকাদের হাতে চিমুদের পতনের আগের সময়ের সাক্ষী কিছু মানুষ অন্তত বেঁচেছিলেন। স্পেনীয় ঐতিহাসিকরা তাদের কাছ থেকে চিমুদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে লিখে গেছেন বলে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীতও তাদের সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য অন্তত আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পারি, মোচেদের উত্তরাধিকারী হিসেবেই তাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। চিমুদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলি, অন্তত তাদের প্রথম যুগে, দেখা যায় মোচেদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলির সাথে বৈশিষ্ট্যগতভাবে অনেকটাই একইরকম। প্রায়শই এগুলি দেখতে হত কোনও না কোনও জীবজন্তুর মতো। এছাড়া ছয়তলযুক্ত কোনও বোতল বা পাত্রের উপরে কোনও দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তি মানুষের মূর্তিও অনেকসময়ই দেখতে পাওয়া যায়। চিমু মৃৎপাত্রগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এতে কালো রঙের ব্যবহার বিশেষ করে চোখে পড়ে। বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করে প্রস্তুত তাদের ধাতুশিল্পেও সুক্ষ্মতা ও দক্ষতার যথেষ্ট পরিচয় মেলে। মূলত সোনা, রূপা ও তামার মিশ্রিত একধরনের সংকর ধাতুর ব্যাপক ব্যবহার ছিল চিমুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।[৪৪] কৃষি ও মাছ ধরা ছিল তাদের সভ্যতার দুই মূল ভিত্তি। কৃষির জন্য তারা জলসেচের এক বিরাট ও জটিল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মোচে নদী থেকে জলসেচের মাধ্যমে তারা প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে চাষের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের মূল ফসল ছিল ভুট্টাতুলো[৪৪] তাদের ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তারা ছিল চন্দ্র উপাসক। সূর্য উপাসক ইনকাদের সাথে তাদের ধর্মাচরণের মূল পার্থক্য ছিল এইখানেই। দেবতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করা ছিল তাদের ধর্মাচরণের আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।[৪৫]

ইনকা সভ্যতা সম্পাদনা

মূল নিবন্ধইনকা সাম্রাজ্য

 
মাচু পিচু, ইনকা সভ্যতার একটি নিদর্শন

বর্তমান পেরুর কোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি উপজাতি হিসাবে। দ্বাদশ শতাব্দিতে মধ্য আমেরিকা থেকে আগত একদল ভাগ্যান্বেষি পেরুর কুজকো (Cuzko) উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে। আগত এই জনগোষ্ঠির মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগর, কামার ইত্যাদি। স্থানীয় লোকেদের পরাভূত করে হাতুন তামাক নামক এক সাহসী যোদ্ধা ১৩৯০ সালের দিকে কুজকো উপত্যকায় একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাজত্বের নাম হয় ইনকা এবং রাজা কাপাক নিজেকে ভিরাকোচা ইনকা (জনগণের ঈশ্বর) নামে ভূষিত করেন। বলা যেতে পারে ইনকা সভ্যতার সূচনা কিছুটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে হয়েছিল।

ইনকা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এই আন্দীয় সভ্যতায় টাকার প্রচলন ছিল এবং ভোগ্যপণ্য ও বিলাসপণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সভ্যতায় কর ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। বলা হয়ে থাকে যে কর উত্তোলকরা বিভিন্ন পশু, বৃদ্ধ বা দাসের বলি উৎসর্গ হিসেবে গ্রহণ করত।

এস্পানিওল কনকুইস্তাদর (অভিযাত্রী বাহিনী) -দের সেনাধ্যক্ষ ফ্রান্সিসকো পিজারো, শেষ ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপাকে বন্দী করেন এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। সেই সঙ্গে স্প্যানিশ বিজেতাদের হাতে ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইনকাদের শেষ শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটে। কিন্তু এর আগে ১৪৩৮ - ১৫৩৩ সালের মধ্যে এদের সভ্যতা ও সাম্রাজ্য তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। নিজেদের সাম্রাজ্য ও প্রভাবাধীন এলাকা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এরা সরাসরি যুদ্ধের পাশাপাশি নানাধরনের আপাত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিও ব্যবহার করে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম অংশের এক বিশাল ভূখণ্ডকে নিজেদের শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়। বর্তমান পেরুর আন্দিজ পর্বতমালাকে কেন্দ্র করে এদের শাসনাধীন ও প্রভাবাধীন এলাকা ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান ইকুয়েডর, পশ্চিম ও দক্ষিণমধ্য বলিভিয়া, উত্তরপশ্চিম আর্জেন্তিনা, উত্তর ও উত্তরমধ্য চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়ায়। তাদের এই সাম্রাজ্য ছিল এতটাই বিশাল যে ১৫৩০ সাল নাগাদ তার আয়তন ছিল প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটার; এই বিশাল ভূখণ্ডের বাসিন্দা ছিল ২০০টিরও বেশি আলাদা আলাদা জাতি, যারা সকলেই ছিল ইনকাদের শাসনাধীন।[৪৬]

মুইজকা সম্পাদনা

 
স্বর্ণনির্মিত মুইজকা ভেলা - এল ডোরাডো উপকথার জন্মের পিছনে এই ধরনের স্বর্ণ্নির্মিত শিল্পের ভূমিকা কম ছিল না।

মূল নিবন্ধ - মুইজকা উপজাতি

বর্তমান কলম্বিয়ার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে, আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব রেঞ্জের (কর্ডিলিয়েরা ওরিয়েন্টাল) উচ্চভূমিতে মুইজকা উপজাতির মানুষ ইনকাদের ও অন্যান্য আন্দীয় সভ্যতার আওতার বাইরে থেকেই একধরনের পৃথক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। প্রায় ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তারা বসবাস করতো। তারা ছিল চিবচা ভাষী মানুষ। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা প্রথম স্পেনীয়দের সংস্পর্শে আসে। এদের অবশ্য কোনও ঐক্যবদ্ধ রাজ্য গড়ে ওঠেনি। তারা ছোট ছোট অঞ্চলকে ভিত্তি করেই তাদের পৃথক পৃথক গোষ্ঠীশাসন গড়ে তুলেছিল। এইসব গোষ্ঠীর প্রধান বা নেতাদের বলা হত কাথিকে; কিন্তু এইসব কাথিকেদের নেতৃত্বে তারা তাদের ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে একসাথে করে কতগুলি রাজ্যজোট গড়ে তোলে। এই রাজ্যজোটগুলিতে থাকা প্রতিটি পৃথক রাজ্যই ছিল স্বাধীন, কিন্তু তারা তাদের কিছু সাধারণ স্বার্থে এই ধরনের অপেক্ষাকৃত বড় জোট গড়ে তোলে। এরকম তিনটি জোটের কথা জানতে পারা যায়, যাদের নেতা ছিল তিনজন - থাকে, থিপা ও ইরাকা। এদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল, তেমনি বৈরিতাও কম ছিল না।[৪৭]

তবে এরা ছিল যথেষ্ট উন্নত। অন্তত ইউরোপীয়দের আগমণের কালে বা তার অব্যবহিত পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী সমাজ ও অর্থনীতি ছিল এরা। বিশেষ করে খনিশিল্পে তাদের যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে। তারা পান্না, তামা, কয়লা, সোনা, প্রভৃতি খনিজ সম্পদে ছিল বেশ ধনী। তাদের অর্থনীতিও ছিল যথেষ্ট মজবুত। বিশেষত সোনার সুক্ষ্ম অলঙ্করণের কাজে এদের দক্ষতা ছিল তুলনাহীন। হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণশহর এল ডোরাডোর উপকথার জন্মের পিছনে এদের স্বর্ণপ্রাচূর্যের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল বলেই মনে করা হয়। মূলত বিনিময় প্রথায় তারা বাণিজ্য করতো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে নানাপ্রকার বিলাসসামগ্রী - সবই তারা এইভাবেই বিনিময় করতো। তাদের সমাজ মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক। কৃষির প্রয়োজনে তারা আন্দিজের উচ্চভূমিতেও সেচব্যবস্থা ও ধাপ কেটে চাষের জমি গড়ে তুলেছিল। বুনন ছিল তাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। এদের বোনা নানাধরনের অত্যন্ত জটিল বুননের সুক্ষ্ম কাপড়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে।[৪৮]

এদের সমাজে খেলাধূলার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ক্রীড়া ছিল বহুক্ষেত্রেই তাদের ধর্মীয় আচারের একটি অঙ্গ। এইসব খেলার মধ্যে তেহো নামক ধাতব চাকতি নির্ভর একটি খেলা কলম্বিয়ায় আজও জনপ্রিয়। এছাড়া কুস্তিও ছিল আরেকটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ খেলা। এই খেলায় বিজয়ীকে গোষ্ঠীপ্রধানের তরফ থেকে সুক্ষ্ম একটি শাল উপহার দেওয়া হত এবং তাকে গুয়েচে বা যোদ্ধা বলে গণ্য করা হত।

এরা ছিল মূলত সূর্যের উপাসক। সোগামোসো বা সূর্যদেবের পবিত্র শহরে তাদের প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। পুরোহিতদের এদের সমাজে যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ছোট থেকেই তাদের আলাদা ধরনের শিক্ষা দেওয়া হত। চাষবাস থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত সবকিছুতেই তাদের পরামর্শের খুবই গুরুত্ব ছিল। প্রচলিত গল্পের পরম্পরা থেকে মনে করা হয়, শুরুতে তাদের ধর্মে নরবলিরও প্রচলন ছিল। কিন্তু স্পেনীয়দের সংস্পর্শে আসার আগেই এই প্রথা অবলুপ্ত হয়েছিল। কারণ স্পেনীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে এরকম কোনও নরবলির কথা শুনতে পাওয়া যায় না। ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনীয়দের হাতে এদের পতন ঘটে।[৪৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Doris Kurella: Kulturen und Bauwerke des Alten Peru. Kröner, Stuttgart 2008, আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৫২০-৫০৫০১-৯.
  2. John Alden Mason: Das alte Peru. Eine indianische Hochkultur. Kindler, Zürich 1965.
  3. Schjellerup, Inge R. Incas and Spaniards in the Conquest of the Chachapoyas. Göteborg University, 1997.
  4. Lieselotte und Theodor Engl: Die Eroberung Perus in Augenzeugenberichten. 2. Aufl., Dt. Taschenbuch-Verl., München 1977. আইএসবিএন ৩-৪২৩-০১১০০-৯.
  5. সুমিতা দাস. কলম্বাসের পর আমেরিকা: ধ্বংস মৃত্যু লুন্ঠন ও গণহত্যা. পিপলস বুক সোসাইটি: কলকাতা, ২০১৫। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬৭-৭. পৃঃ - ১১৫ - ১১৭।
  6. এই দুই নাম নিয়ে বিতর্ক আছে। ৯০'এর দশকে যাঁর নেতৃত্বে এই সভ্যতার উপর সবচেয়ে বেশি কাজ হয় সেই পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ রুথ শেডি সলিস এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে এই কাজে তাঁর সহযোগী মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথন হাস ও উইনিফ্রেড ক্রিমার এই সভ্যতাকে নর্তে চিকো সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। যেহেতু দ্বিতীয়দলের মতামত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, (Miller, Kenneth. "Showdown at the O.K. Caral: Archaeologists have an uncivilized fight over how civilization began in the Americas". Discover. 09 September, 2005. সংগৃহীত ১ জুলাই, ২০১৫।) এখানে সাধারণভাবে এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে।
  7. "Sacred City of Caral-Supe". UNESCO World Heritage List. সংগৃহীত ১ জুলাই, ২০১৫।
  8. Haas, Jonathan; Winifred Creamer; Alvaro Ruiz. "Dating the Late Archaic occupation of the Norte Chico region in Peru". Nature 432, 1020–1023 (23 December 2004). doi:10.1038/nature03146. সংগৃহীত ১ জুলাই, ২০১৫।
  9. 15616561 সংগৃহীত ১ জুলাই, ২০১৫।
  10. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. পিপলস বুক সোসাইটি: কলকাতা, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৭৫ - ৭৭।
  11. Stothert, Karen E.: "The Preceramic Las Vegas Culture of Coastal Ecuador".(July 1985). American Antiquity. 50(3): পৃঃ - ৬১৩ - ৩৭। doi:10.2307/280325
  12. Stothert, Karen E.; Dolores R. Piperno; Thomas C. Andres (Fall 2004). "New Evidence of Early Holocene Agriculture from the Coast of Ecuador: A Multidisciplinary Approach". Culture & Agriculture 24 (2): পৃঃ - ৩১ - ৪১।
  13. Bryan, Alan L.: "Early Adaptations to South American Environments". Chapter 2: The Original Peopling of Latin America. Las sociedades originarias. সংগৃহীত ৬ জুলাই, ২০১৫।
  14. Wolfson, Nessa; Manes, Joan. Language of Inequality. 1985. আইএসবিএন ৯৭৮-৩১১০০৯৯৪৬১ পৃঃ - ১৮৬।
  15. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. পিপলস বুক সোসাইটি: কলকাতা, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৭৮ - ৭৯।
  16. Burger, Richard L. Chavin and the Origins of Andean Civilization. New York: Thames and Hudson, 1992.
  17. Tello, Julio C. (1943) "Discovery of the Chavín Culture in Peru", American Antiquity 9(1, Countries South of the Rio Grande). পৃঃ - ১৩৫ - ১৬০।
  18. Raymond, J. Scott: "Ceremonialism in the Earrly Formative of Ecuador". Senri Ethnological Studies. 37, 1993. পৃঃ - ২৫ – ৪৩।
  19. Burger, Richard L. (2009). The life and writings of Julio C. Tello: America's first indigenous archaeologist. Iowa: University of Iowa Press. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৫৮৭২৯-৭৮৩-০. পৃঃ - ১, ২৮, ৩৭ - ৩৮।
  20. Paracas textile. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ নভেম্বর ২০১০ তারিখে The British Museum. সংগৃহীত ১৬ জুলাই, ২০১৫।
  21. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৮২ - ৮৫।
  22. Reiche, Maria: Vorgeschichtliche Scharrbilder in Peru. In: Photographie und Forschung. Werkszeitung ZEISS-IKON, Bd. 6, Heft 4, 1954
  23. Reiche, Maria: Vorgeschichtliche Bodenzeichnungen in Peru. In: Die Umschau in Wissenschaft und Technik. Umschau Verlag, 55. Jahrgang, Heft 11, 1955
  24. Reiche, Maria: Peruanische Erdzeichnungen/Peruvian Ground Drawings. Hrsg: Kunstraum München e.V., München, 1974
  25. Beresford-Jones, D., S. Arce, O.Q. Whaley and A. Chepstow-Lusty. "The Role of Prosopis in Ecological and Landscape Change in the Samaca Basin, Lower Ica Valley, South Coast Peru from the Early Horizon to the Late Intermediate Period ". Latin American Antiquity Vol. 20 পৃঃ - ৩০৩ - ৩৩০।
  26. Beck, Roger B.; Black, Linda; Krieger, Larry S.; Naylor, Phillip C.; Ibo Shabaka, Dahia (1999). World History: Patterns of Interaction. Evanston, IL: McDougal Littell. আইএসবিএন ০-৩৯৫-৮৭২৭৪-X.
  27. Bawden, G. "The Art of Moche Politics", in Andean Archaeology. Ed. H. Silverman. Oxford: Blackwell Publishers, 2004.
  28. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৮০ - ৮১।
  29. Kolata, Alan L. The Tiwanaku: Portrait of an Andean Civilization. Wiley-Blackwell, 1993. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৫৫৭৮৬-১৮৩-২.
  30. "Tiwanaku: Spiritual and Political Centre of the Tiwanaku Culture". World Heritage List. UNESCO. সংগৃহীত ২ আগস্ট, ২০১৫।
  31. Fagan, Brian M. The Seventy Great Mysteries of the Ancient World: Unlocking the Secrets of Past Civilizations, New York: Thames & Hudson, 2001.
  32. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৮৮ - ৯০।
  33. Pedro de Cieza de León (1553): The seventeen years travels of Peter de Cieza through the mighty kingdom of Peru, and the large provinces of Cartagena and Popayan in South America: from the city of Panama, on the isthmus, to the frontiers of Chile. Tr. & Ed. Markham. London: Hakluyt Society, MDCCIX.
  34. Giffhorn, Hans. Wurde Amerika in der Antike entdeckt?: Karthager, Kelten und das Rätsel der Chachapoya. 2nd ed. C.H. Beck, 2014. আইএসবিএন ৩৪০৬৬৬৪৮৯X, 9783406664892.
  35. Nystrom, Kenneth; Buikstra, Jane; Muscutt, Keith (2010), "Chachapoya mortuary behavior: a consideration of method and meaning.", Revista de Antropología Chilena 42 (2): 477–495,doi.org/10.4067/S0717-73562010000200010 সংগৃহীত ২৮ জুলাই, ২০১৫।
  36. Hagen, Adriana von. An Overview of Chachapoya Archaeology and History. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে সংগৃহীত ২৮ জুলাই, ২০১৫।
  37. Susan E. Bergh. Wari: Lords of the Ancient Andes. Thames & Hudson, 2012. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫০০-৫১৬৫৬-০.
  38. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৮৬ - ৮৭।
  39. Ford, Dana. "Archeologists in Peru unearth ancient Wari city". ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে Lima: Reuters, 16 December, 2008. সংগৃহীত ৩১ জুলাই, ২০১৫।
  40. Patrick Ryan Williams & Donna J. Nash, Clash of the Andean Titans: Wari and Tiwanaku at Cerro Baúl. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে fieldmuseum.org. সংগৃহীত ৩১ জুলাই, ২০১৫।
  41. "Jar – The Walter Art Museum."। ২৭ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ আগস্ট ২০১৫ 
  42. Rowe, John H. (1948) "The kingdom of Chimor", Aus Acta Americana 6, (1-2): 27.
  43. Peter Flindell Klarén: Peru. Society and Nationhood in the Andes. New York: Oxford University Press, 2000, আইএসবিএন ০-১৯-৫০৬৯২৮-৫, পৃঃ - ১১।
  44. সুমিতা দাস: কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকা: মুছে দেওয়া সভ্যতার ইতিহাস. কোলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ২০১৪। আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৮৩-৬২-৬. পৃঃ - ৯১ - ৯২।
  45. Ember, Melvin; Peregrine, Peter Neal, eds. (2001). "Chimú". Encyclopedia of Prehistory. 7 : South America (1 ed.). Springer. আইএসবিএন ৯৭৮-০৩০৬৪৬২৬১০.
  46. Alvin M. Josephy: Amerika 1492 – Die Indianervölker vor der Entdeckung. Frankfurt am Main 1992, ISBN 3-10-036712-X, S. 269
  47. Historia de Colombia (tr.en. History of Colombia). Tomo 1 Zamora Editores, Bogotá, Colombia 2003.
  48. Bahn, Paul: Archaeology, Theories, Methods and Practice, 2nd edition, Thames and Hudson, London, 1991. আইএসবিএন ০-৫০০-২৭৮৬৭-৯. পৃঃ - ৩১৭।

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • ড. সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়: লাতিন আমেরিকার তিন সভ্যতা. কলকাতা: কোডেক্স, ২০০৭।
  • Dobyns, Henry F. and Paul L. Peru: A Cultural History. New York: Oxford University Press, 1976.
  • ইনকা গার্সিলাসো দে লা ভেগা: পেরুর প্রাকৃত ইতিহাস. অনুবাদক অশেষ রায়. কোলকাতা: র‍্যাডিক্যাল, ২০১১। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮৫৪৫৯-৩৬-৩.