থু ইঔ-ইঔ

চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী
(ইউইউ তু থেকে পুনর্নির্দেশিত)

থু ইঔ-ইঔ (চীনা: 屠呦呦; জন্ম: ৩০ ডিসেম্বর ১৯৩০) একজন চীনা চিকিৎসা বিজ্ঞানী, চিকিৎসা রসায়নবিদ এবং প্রশিক্ষক যিনি সর্বাধিক পরিচিত আরটেমিসিনিন ( একে Qinghaosu-ও বলা হয়) এবং ডিহাইড্রোয়ারটেমিসিনিন আবিষ্কারের জন্য যেগুলো ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচিয়েছে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের মানুষের সাস্থ্য উন্নয়নে আরটেমিসিনিন আবিষ্কার ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে এর ব্যবহার বিংশ শতাব্দীর ট্রপিক্যাল মেডিসিনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। তার কাজের জন্য থু ২০১১ সালে ক্লিনিকাল মেডিসিনে ল্যাস্কার পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। থু ইঔ-ইঔ হচ্ছেন ইতিহাসের প্রথম ল্যাস্কার পুরস্কার বিজয়ী চীনা যিনি চীনে লেখাপড়া করেন এবং যার গবেষণা কর্ম চীনে হয়েছিল।[১]

থু ইঔ-ইঔ
屠呦呦
১৯৫১ সালের ছবিতে থু ইঔ-ইঔ (ডানে) এবং তার শিক্ষক লূ ঝিচেন(楼之岑) (বামে)
জন্ম (1930-12-30) ৩০ ডিসেম্বর ১৯৩০ (বয়স ৯৩)
জাতীয়তাচীনা
মাতৃশিক্ষায়তনবেইজিং মেডিকেল কলেজ (বর্তমানেপেকিং ইউনিভার্সিটি হেলথ সাইন্স সেন্টার)
পরিচিতির কারণট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন
চাইনিজ হারবলজি
আরটেমিসিনিন
ডিহাইড্রোয়ারটেমিসিনিন
পুরস্কারঅ্যালবার্ট ল্যাস্কার অ্যাওয়ার্ড ফর ক্লিনিকাল মেডিকেল রিসার্চ (২০১১)
ওয়ারেন অ্যালপার্ট ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০১৫)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (২০১৫)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রক্লিনিক্যাল মেডিসিন
চিকিৎসা রসায়ন
প্রতিষ্ঠানসমূহচায়না একাডেমী অফ চাইনিজ মেডিকেল রিসার্চ
থু ইঔ-ইঔ
চীনা 屠呦呦

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৬০ এবং ৭০ এর দিকে থু ইঔ-ইঔ যখন গবেষণা করছিলেন তখন চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলছিল এবং মাও এর তত্ত্বানুযায়ী বিজ্ঞানীগণ নয় কালো তালিকায় ছিলেন। কিন্তু চীনের বন্ধু উত্তর ভিয়েতনাম, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আমেরিকার বিপক্ষে যুদ্ধরত ছিল। ম্যালেরিয়া উপর তখন ক্লোরোকুইনের প্রভাব অকার্যকর হয়ে গেলে ম্যালেরিয়া মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাড়ায়। এছাড়া চীনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশ হাইনান, ইউন্নান, কুয়াংশি এবং কুয়াংতুং-এ এই রোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। ২৩ মে, ১৯৬৭ সালে এর ওষুধ আবিষ্কারের জন্য Mao Zedong প্রোজেক্ট ৫২৩ নামে একটি গোপন প্রোজেক্ট চালু করেন।[২]

বিশ্বের নান প্রান্তের বিজ্ঞানীগণ ২৪০,০০০ যৌগ পরীক্ষা করে ওষুধ তৈরিতে ব্যর্থ হন। ১৯৬৯ সালে ৩৯ বছর বয়সী থু ইঔ-ইঔ চীনা ঔষধি গাছ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে ইতিহাস থেকে চীনা ভেষজের মৌলিক দিকগুলো জানেন, দেশজুড়ে যারা আগে থেকেই এই ভেষজগুলো নিয়ে লেখাপড়া করতেন, থু ইঔ-ইঔ নিজে তাদের সাথে দেখা করেন এবং একটি বই লিখেন যার নাম A Collection of Single Practical Prescriptions for Anti-Malaria। এই বইয়ে বিভিন্ন বিষয়ে মোট ৬৪০টি চিকিৎসা পদ্ধতির সারমর্ম ছিল। তার দল ২০০০ প্রথাগত চীনা উপাদান পর্যবেক্ষণ করে ৩৮০ টি ভেষজ দ্রব্য প্রস্তুত করে, ইদুরের উপর পরীক্ষা করা হয়।[২]

একটি যৌগ সুইট ওয়ার্মউড(Artemisia annua) ম্যালেরিয়ার একটি হলমার্ক ‘’ইন্টারমিট্টেন্ট ফিভার’’ বিরুদ্ধে সফল হয়। প্রোজেক্ট সেমিনারে থু জানান যে, এই যৌগের প্রস্তুতি উল্লেখ আছে ১৬০০ বছর পুরনো একটি বইয়ে যার নাম "Emergency Prescriptions Kept Up One's Sleeve"। প্রথম দিকে বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী ফুটন্ত পানির সাহায্যে প্রস্তুত করায় যৌগটি কাজ করেনি। থু সিদ্ধান্তে আসেন যে, গরম পানি গাছে ঐ পদার্থটি নষ্ট করে দেয়, তাই তিনি পদার্থটি সংগ্রহের জন্য নিম্ন তাপমাত্রার ইথার ব্যবহার করে সংগ্রহের একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। ইঁদুর এবং বানরে এটি সফলভাবে কাজ করে।[২]

এরপর, মানুষের উপর প্রথম পরীক্ষার স্বার্থে থু সেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, "এই গবেষণা দলের প্রধান হিসেবে আমার উপরেই দায়িত্ব ছিল।" । এটি নিরাপদ প্রমাণিত হয়। তাই তিনি মানুষ রোগীর ওপর সফল ক্লিনিকাল পরীক্ষা চালাতে থাকেন। তার গবেষণাকর্ম নাম, পরিচয় ছাড়া ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করা হয়।[২]

থু বলেন, "মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা বিজ্ঞানীদের।" , "আমি যা করেছি তা দেশ কর্তৃক আমাকে প্রদান করা শিক্ষার বিপরীতে আমার করা উচিত ছিল।"।[২]

তিনি ল্যাস্কার পুরস্কার পেয়ে কৃতজ্ঞ ছিলেন কিন্তু বলেন, "অসংখ্য রোগীকে সুস্থ হতে দেখে আমি বেশি পুরস্কৃত বোধ করি "[২]

জীবনী সম্পাদনা

থু ইঔ-ইঔ ১৯৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর চীনের চচিয়াং প্রদেশের নিংবো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।[৩]

১৯৫১ সালে তিনি পেকিং ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন (১৯৫২ সালে মেডিকেল স্কুলটি বেইজিং মেডিকেল কলেজ নামে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হয়। ১৯৮৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বেইজিং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০০ সালের ৩ এপ্রিল পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে এটি বর্তমানেপেকিং বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান কেন্দ্র নামে পরিচিত।[৪] ফার্মাসিউটিক্যাল অনুষদে অধ্যয়ন করে থু ১৯৫৫ সালে স্নাতক উপাধি অর্জন করেন। পরবর্তীতে থু আড়াই বছর প্রথাগত চীনা মেডিসিনের উপর প্রশিক্ষিত হন।

স্নাতকের পর থু ইঔ-ইঔ বেইজিং-এর অ্যাকাডেমি অফ চাইনিজ মেদিসিন-এ কাজ করেন। বর্তমানে এর নাম চায়না অ্যাকাডেমি অফ চাইনিজ মেডিকেল রিসার্চ। চীনা অর্থনীতির পুনর্গঠনের পর ১৯৮০ সালে থু এখানে একজন গবেষকের মর্যাদায় উন্নীত হন। ২০০১ সালে তিনি ডক্টরেট প্রত্যাশীদের একাডেমীক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানে তিনি এই একাডেমীর প্রধান গবেষক।[৫]

২০০৭ সাল থেকে দংচেং ডিসট্রিক্ট, বেইজিং-এর একটি পুরাতন দালানে তিনি অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।[৩]

২০১১ সালের পূর্ব পর্যন্ত থু লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে “মানুষ তাঁকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে”।[৬]

তাকে গণ্য করা হয় তিন না বিশিষ্ট অধ্যাপক”- না কোন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী (সেসময় চীনে স্নাতকোত্তর শিক্ষা একদম ছিল না), না বিদেশে কোন গবেষণার অভিজ্ঞতা, না চীনার কোন জাতীয় একাডেমীর সদস্য, উদাহরণস্বরূপ চাইনিজ একাডেমী অফ সাইন্সেস এবং চাইনিজ একাডেমী অফ ইঞ্জিনিয়ারিং[৭] ১৯৭৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত চীনে স্নাতকোত্তর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না এবং চীন বাকি পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৪৯ সালে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থু ইঔ-ইঔকে চীনা চিকিৎসা পদ্ধতিতে কাজ করেছেন যারা তাদের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়।[৮]

পুরস্কার সম্পাদনা

  • রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস পুরস্কার, চীন ১৯৭৮[৯]
  • রাষ্ট্রীয় উদ্ভাবক পুরস্কার, চীন ১৯৭৯
  • চীনের শীর্ষ দশটি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অবদানের ভিতর একটা, ১৯৯২[৯]
  • চীনের শীর্ষ দশটি রাজ্যিয় স্বাস্থ্য অবদানের ভিতর একটা, ১৯৯৭ [৯]
  • জীববিজ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট অবদানের জন্য গ্লাসোস্মিথক্লিন পুরস্কার, ২০১১[১০]
  • লাস্কের ডিবাকী ক্লিনিকেল মেডিকেল রিসার্চ পুরস্কার, ২০১১[১১]
  • সর্বোৎকৃষ্ট অবদানের জন্য পুরস্কার, চায়না একাডেমী অফ চাইনীজ মেডিকেল সাইন্স, ২০১১[১২]
  • শ্রেষ্ঠ দশ জন মহিলার ভিতর একজন, চীন, ২০১২[১৩]
  • ওয়ারেন আলপার্ট ফাউণ্ডেশন পুরস্কার, ২০১৫[১৪]
  • চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার, ২০১৫[১৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Miller, Louis H.; Su, Xinzhuan (২০১১)। "Artemisinin: Discovery from the Chinese Herbal Garden"Cell146 (6): 855–8। ডিওআই:10.1016/j.cell.2011.08.024পিএমআইডি 21907397পিএমসি 3414217  
  2. The modest woman who beat malaria for China, by Phil McKenna, New Scientist, 15 November 2011
  3. "Magic Drug Saved Half Billion People" (চীনা ভাষায়)। Phoenix Television News, Hong Kong। ১৬ মার্চ ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  4. "Introduction"Peking University Health Science Center। ২০১০-১০-২৭। ২০১১-০৭-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  5. "Official Biography" (চীনা ভাষায়)। China Academy of Chinese Medical Sciences। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  6. 屠呦呦膺世界級醫學大獎 (চীনা ভাষায়)। Hong Kong Wen Wei Po। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  7. 屠呦呦获拉斯克奖 评论认为离诺奖只一步之遥 (চীনা ভাষায়)। Sohu News। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  8. 屠呦呦:新中国第一代药学家 研发青蒿素 (চীনা ভাষায়)। Sohu News। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  9. "Tu Youyou 屠呦呦"China Vitae। ২৯ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১২ 
  10. "Chen Zhili Congratulates Lasker Award Winner Tu Youyou"Women of China। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৬ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১২ 
  11. "Tu Youyou"Lasker Foundation। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১। ৮ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  12. "Tu is awarded Outstanding Contribution Award by CACMR" (চীনা ভাষায়)। Xinhua News Agency। ১৫ নভেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  13. 吴菊萍屠呦呦获授三八红旗手标兵 (চীনা ভাষায়)। Sina.com News। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১২ 
  14. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" Alpert Prize Recognizes Malaria Breakthroughs। Warren Alpert Foundation। ৪ জুন ২০১৫। ১৪ জুন ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুন ২০১৫ 
  15. "Nobel Prize announcement" (পিডিএফ)NobelPrize.orgNobel Assembly at Karolinska Institutet। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১৫