আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার

আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার (৩ জানুয়ারি ১৯৪৩- ৭ আগস্ট ১৯৭১) ছিলেন কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ কুড়িগ্রাম কলেজের ইতিহাস বিভাগের একজন প্রভাষক এবং একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী।[১] ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ৭ আগস্ট তাঁকে হত্যা করা হয়।

আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার
জন্ম
আবদুল ওয়াহাব তালুকদার

৩ জানুয়ারি ১৯৪৩
দিনহাটা মহকুমা, কোচবিহার জেলা, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু৭ আগস্ট ১৯৭১(1971-08-07) (বয়স ২৮)
ভুরুঙ্গামারী থানা, কুড়িগ্রাম
পেশাশিক্ষকতা
কর্মজীবন১৯৬৫-১৯৭১
পরিচিতির কারণশিক্ষক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী

প্রাথমিক ও পারিবারিক জীবন সম্পাদনা

শহীদ ওয়াহাব তালুকদার ১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার কালমাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছামান আলী ছিলেন একজন কৃষক এবং মা সালমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। ওয়াহাব তালুকদার তার পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার চতুর্থ। ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তারা সপরিবারে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ভুরুঙ্গামারী থানার সিংঝাড় গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ওয়াহাব তালুকদার তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এদেশে আসার অল্প কিছুদিন পরেই বাবা হারান তিনি।

লেখাপড়া শেষ করে চাকরিরত অবস্থায় মনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। মনোয়ারা বেগম সন্তান জন্ম দেওয়ার এগারো দিন পরই মারা যান। পরে তিনি বিয়ে করেন মেশরুন নাহারকে। ওয়াহাব তালুকদার তিন সন্তানের জনক।[২]

শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পাদনা

বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওয়াহাব তালুকদার প্রথমে পড়াশোনা করেন স্থানীয় বাউশমারী মাদ্রাসায়। এরপর ভুরুঙ্গামারী পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ওয়াহাব তালুকদার ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর তিনি ভর্তি হন রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজে। কারমাইকেল কলেজ থেকে তিনি ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬২ সালে ডিগ্রী পাশ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এম.এ. পাশ করেন।  পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে পরবর্তীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। ১৯৬৫ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পূর্ব-পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্মতৎপরতা সম্পাদনা

এদেশের অসংখ্য স্বাধীনতা পাগল মানুষদের মধ্যে শহীদ ওয়াহাব তালুকদার ছিলেন অন্যতম। তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধে একজন সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি তার কিছু ছাত্রদের সাথে প্রথমবারের মতো পরিকল্পনা করেন। এর কয়েকদিন পরই তিনি সপরিবারে কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে নিজ গ্রামে চলে যান এবং এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়র ওয়াহাব তালুকদার ১ মে থেকে ১ জুন ১৯৭১ পর্যন্ত বামনহাট যুব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। এবং পরবর্তীতে ৬নং সেক্টরের অধীন বামনহাট যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, ৬ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এম. কে. আবুল বাশার, বীর উত্তম।[২]

আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত অসংখ্য যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত ও সংগঠিত করতে থাকেন। সেই সাথে যুবক ও অন্যান্যদের যুব শিবিরে ভর্তি শেষে উচ্চতর প্রশিক্ষণে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান তিনি। যুব শিবিরে নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, খাবার, রেশন, বাসস্থানসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সক্রিয় সংগঠক হিসেবে কাজ করে যান আমৃত্যু।[২]

হত্যা সম্পাদনা

ভারতের বামনহাটে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়শই তিনি নিজ গ্রামে আসতেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজ পরিবারের সাথে দেখা করা এবং নিজ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেয়া। ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট তিনি গ্রাম থেকে বামনহাটের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথিমধ্যে বামনহাট থেকে আসা কয়েকজন সহকর্মীসহ সিংঝাড় গ্রামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বগনী-সেতুতে অবস্থানরত একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। এমন সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একদল সিপাই রেল লাইনের পাশ দিয়ে এসে অতর্কিত আক্রমণ করে। অতর্কিত এই আক্রমণে পুরো দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার রেললাইন ধরে দৌড়াতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার পায়ে গুলি লাগে। তিনি রেললাইনের পাশের জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ঠিকই খুঁজে বের করে এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর তাকে ফেলে দেয়া হয় পার্শ্ববর্তী একটি ডোবায়। পরে ভারতীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বগনী নদীর কিনারে অবস্থিত কালমাটি মসজিদ চত্বরে তাঁকে দাফন করা হয়।[২]

শহীদ আব্দুল ওয়াহাব তালুকদারের নামে কুড়িগ্রাম শহরে একটি সড়ক রয়েছে এবং ঐতিহ্যবাহী কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. রাশেদুর রহমান। "আবদুল ওয়াহাব তালুকদার"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৮ 
  2. "আবদুল ওয়াহাব তালুকদার"gunijan.org.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৮