আবু তোরাব

সন্দ্বীপের জমিদার ও স্বাধীনতা সংগ্রামী

চৌধুরী আবু তোরাব খাঁ (?-১৭৬৭), যিনি আবু তোরাব নামেও পরিচিত, অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন বাঙ্গালী জমিদার ছিলেন। মূলত সন্দ্বীপের জমিদার হলেও, তার আধিপত্য বাদে হাতিয়া ও বামনী জিঞ্জিরায় বিস্তৃত হয়। তিনি বিলাতী পূর্ব ভারত কারবারের বিরুদ্ধে বাংলার পহেলা বিদ্রোহী নেতা হিসাবে বেশী পরিচিত। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে তার দৃঢ় সমর্থন ছিল এবং বাংলার ইতিহাসে তাকে একজন বীর হিসাবে গণ্য করা হয়।

প্রারম্ভিক জিন্দেগী এবং পটভূমি সম্পাদনা

আবু তোরাব মোগল আমলে সুবাহ বাংলার সন্দ্বীপে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী মুসলিম জমিদার খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাপের নাম ছিলেন মুহম্মদ রাজা, যিনি চাঁদ খাঁর অন্যতম ছেলে জুনুদ খাঁর ছেলে। পরদাদা চাঁদ খান বিয়ে করেছিলেন মুসাবিবিকে যিনি ছিলেন সন্দ্বীপের আখেরী আজাদ রাজা দেলোয়ার খাঁর ব​ড় কন্যা।

উত্থান সম্পাদনা

সন্দ্বীপের পশ্চিম কিনারায় হরিশপুর গ্রামে তোরাবের মহলটি অবস্থিত ছিল। [১] ইংরেজ সূত্র অনুসারে, তিনি ১৫০০ সশস্ত্র গোলামদের একটি মজবূৎ ফৌজ তৈরি করেছিলেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য তিনি একটি ঘর সরবরাহ করেছিলেন, যদিও স্থানীয় সূত্র দাবি করে যে এটি সাচ্চা নয়। [২] আবু তোরাব তার এলাকার তামাম স্থানীয় জমিদারদের উপর কর্তৃত্ব করেছিলেন এবং এসব জমিদাররা তাকে গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে জঙ্গে মদদ করেছিল। গোকুল ঘোষাল ছিল খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং চাটগাঁর পহেলা ইংরেজ গভর্নর হ্যারি ভেরেলেস্টের কেরানি। ঘোষালের পরামর্শে, ভেরেস্ট ১৭৬৩ সালে সন্দ্বীপ দখল করেন এবং মোগল ওয়াদাদার ওজাকুর মলের বদলে ঘোষালকে প্রতিস্থাপন করেন। ভেরেলেস্টের একজন অনুগত কর্মচারী বিষ্ণুচরণ বসু ব্রিটিশ সন্দ্বীপে প্রথম ওয়াদাদারের দায়িত্ব নেন। সেই সময় রাম কিশোর বদুজেজ বসুর সহকারী নিযুক্ত হন। বলা বাহুল্য, আবু তোরাব চৌধুরী গোকুল ঘোষালের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেননি কারণ ঘোষাল ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৪ সালের মাঝে ইংরেজ পূর্ব ভারত কারবারের পক্ষে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে সন্দ্বীপে এসেছিলেন। রাম কিশোর সন্দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথে আবু তোরাব তার প্রতিহেফাজতের জন্য তৈয়ার হন। [৩]

ইনকিলাব সম্পাদনা

১৭৫৭ সালে পলাশীর জঙ্গের বাদে বাংলায় বিলাতী দখলের সূচনা হয়। এই ঘটনার ঠিক ১০ বছর পর, আবু তোরাব সন্দ্বীপের জনগণকে একত্রিত করেন এবং চাটগাঁর গভর্নর হ্যারি ভেরেলেস্ট এবং তার দেশীয় মিত্র যেমন গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। আবু তোরাব রাজস্ব জমা করা থেকে বিরত থাকেন এবং তার সেনাপতি মালকাম সিংকে ঘোষালের তামাম প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। চাটগাঁওলক্ষ্মীপুর থেকে একদল কোম্পানি সৈন্য আবু তোরাব ও তার সেনাপতির সাথে যুদ্ধ করতে আসে। প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কয়েকদিনের মাঝেই সন্দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হয় ঘোষালের প্রতিনিধিরা। [৩]

এন্তেকাল সম্পাদনা

অবশেষে, ১৭৬৭-এর মাঝখানে ক্যাপ্টেন নলেকিন্স এবং কয়েক অন্যান্য জেনারেলদের নেতৃত্বে ছয় কোম্পানির সৈন্য নদী পার হয়ে সন্দ্বীপ পৌঁছে [৪] সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চর আনি হাট থেকে দূরে কেল্লাবাড়িতে ক্যাপ্টেন নলেকিন্সের ফৌজ এবং আবু তোরাবের ফৌজের মাঝে একটি ভয়াবহ জঙ্গ সংঘটিত হয়। আবু তোরাব তার এক নিকটাত্মীয়ের গদ্দারীর (তার জঙ্গ-কৌশল ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে ফাঁস করেছিল) ফলে এই জঙ্গে মারা যান। তার সশস্ত্র গোলাম ফৌজ সন্দ্বীপের বর্তমান 'গোলাম' শ্রেণীর পূর্বপুরুষ।[৫]

ওয়ারিশ সম্পাদনা

আবু তোরাবের পতনের বাদে সন্দ্বীপের ছোট জমিদাররা তাদের জমিদারী ফেরত পেতে গোকুল ঘোষালের জুলুম-অত্যাচার মেনে নেন। সন্দ্বীপের শাসক হওয়ার বাদে, গোকুল ঘোষাল ভবানীচরণ দাসকে আবু তোরাবের জমিদারী প্রদান করেন। কিছুকাল বাদে, ঘোষাল সন্দ্বীপের তামাম জমিদারী পুনরুদ্ধার করে এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। এই ঘোষাল বংশ দুর্নীতি, লুটপাট, লবণ ইজারা এবং বেনামী জমিদারীর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছিল।[৬] খিদিরপুরে ঘোষালদের ভূকাইলাস প্রাসাদটি আজও দাঁড়িয়ে আছে, যা সন্দ্বীপের কৃষকদের সম্পদ দিয়ে নির্মিত, এবং স্থানীয়রা ঘৃণার সাথে প্রাসাদটি স্মরণ করে। ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে বেশুমার সংযুক্ত ইনকিলাব সন্দ্বীপে সংঘটিত হয়, ১৯৪৭ সাল ভারত ভাগ পর্যন্ত।

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Chowdhury, ABM Siddiq (১৯৮৮)। শাশ্বত সন্দ্বীপ 
  2. AFM Abdul Jalil (১৯৭৪)। পূর্ব বাংলার কৃষক বিদ্রোহ। Prakash Bhaban। পৃষ্ঠা 21। 
  3. Shahidullah, Muhammadসন্দ্বীপ উত্তরন 
  4. Abul Kalam Elias (১৬ ডিসেম্বর ২০০৩)। "The contribution of Sandwip to the struggle for freedom"The Daily Star4। ৭ অক্টোবর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০২২ 
  5. Chowdhury, Abdul Hoque (১৯৮৮)। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতিBangla Academy। পৃষ্ঠা 444। 
  6. Arif, Anindya (১২ আগস্ট ২০১৪)। সন্দ্বীপের বিদ্রোহKaler Kantho