আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা আস সাহমী
আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফাহ আস-সাহমী ছিলেন নবী মুহাম্মদের ﷺ একজন সহচর।[১] তিনি পারস্যের রাজা খসরু পারভেজের কাছে মুহাম্মদের ﷺ কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠির বাহক ছিলেন এবং সম্রাট হেরাক্লিয়াস দ্বারা কারাবরণ ও নির্যাতনের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
নাম ও বংশ পরিচয়
সম্পাদনাআবদুল্লাহ-এর পিতার নাম হুজাফাহ আস-সাহমী। তিনি কুরাইশ বংশের বনী সাহম শাখার সন্তান।
ইসলাম গ্রহণ
সম্পাদনাতিনি মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুয়তের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ভাই কায়েস ইবনে হুজাফাকে সঙ্গে করে হাবশাগামী মুহাজিরদের দ্বিতীয় কাফিলার সাথে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ
সম্পাদনাআবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা একমাত্র বদর ছাড়া সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবু সাঈদ আল খুদরী তাকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মুসা ইবনে উকবা, ইবনে ইসহাক ও অন্যরা তাকে বদরী সাহাবা বলে উল্লেখ করেননি।
একটি অভিযানের নেতা
সম্পাদনামুহাম্মাদ (সাঃ) একবার একটি অভিযানের নেতা বানিয়ে তাকে প্রেরন করেন, পথিমধ্যে তিনি হটাৎ রেগে গিয়ে তাদের আগুনের কুণ্ডলী বানাতে বলে, এবং এর মধ্যে ঝাপিয়ে পরতে বলে।[২] তবে ইমাম আসাকির যুহরী বলেন, আবদুল্লাহ একজন রসিক মানুষ ছিলেন,[৩] তিনি এই আদেশ রসিকতা করে দিয়েছিলেন।[৪] পরে অভিযান থেকে ফিরে আসলে ইসলামী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, নেতার আনুগত্য কেবল এমন সব ব্যাপারে ওয়াজিব, যার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন।[৫]
বনু জুজাইমা গোত্রে দাওয়াত
সম্পাদনামক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মাদ খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে বনু জুজাইমা গোত্রে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য পাঠালেন। এই কার্যক্রম ছিলো শুধুমাত্র দাওয়াতী, কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়। কিন্তু ভুল বুঝাবুঝির কারণে খালিদ তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসেন এবং তাদের বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। এ ঘটনায় মুহাম্মাদ (সাঃ) খুব মর্মাহত হন এবং তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দান করেন এবং খালিদকেও ক্ষমা করে দেন। ইবনে ইসহাক বলেন, এ ব্যাপারে খালিদকে কৈফিয়ত করা হলে তিনি বললেন, 'আমি আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফার আদেশেই তাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। আবদুল্লাহ বলেছিলেন, তারা যদি ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন।’[৬]
পারস্যের সম্রাটের নিকট দাওয়াত
সম্পাদনা৬২৮ মতান্তরে ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য ৬ জন সাহাবাকে বেছে নেন। এদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা একজন। তিনি পারস্যের সম্রাট কিসরার (দ্বিতীয় খসরু) নিকট ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলেন। তিনি একটি পত্র হাতে দরবারে প্রবেশ করতে একজন দরবার পরিষদ তার থেকে চিঠিটি নিতে চাইলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা তার কাছে চিঠি দিতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং তিনি সরাসরি চিঠি দ্বিতীয় খসরুর নিকট দিলে, তিনি চিঠিটি পড়েই ক্রোধে ফেটে পরেন, এবং তৎক্ষণাৎ চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলেন। চিঠিতে লেখা ছিলো।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ্র রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ) পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট কিসরার প্রতি। যারা হিদায়াত গ্রহণ করেছে তাদের প্রতি সালাম।”
— মুহাম্মাদ
আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা আস সাহমী এই ঘটনা এসে মুহাম্মাদ (সাঃ) কে জানালে তিনি খসরু পারভেজের ধ্বংসের জন্য দোয়া করেন।[৭]
এদিকে খসরু পারভেজ প্রাদেশিক শাসক ইয়েমেনের গভর্নর বাজানকে চিঠি লিখলেন, তুমি দুজন শক্তিশালী লোক পাঠিয়ে হেজাযে মুহাম্মাদ ﷺ নামে যে ব্যক্তি নবী বলে দাবী করেছে তাকে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসো। তারা প্রথমে মক্কার কুরাইশদের নিকট এসে জানতে পারলো মুহাম্মাদ ﷺ এখন মদিনাতে রয়েছেন। তারা তাঁর নিকট গিয়ে তাদের গভর্নর বাজান ইবনে সান ও সম্রাট দ্বিতীয় খসরু পারভেজের ভয় দেখায়। মহানবি মুহাম্মদ ﷺ তাদের বলেন তোমাদের সম্রাট খসরু পারভেজ নিহত হয়েছে, এবং আমার এ দ্বীন একসময় খসরুর প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছাবে। এরপর তারা বাজানের নিকট ফিরে গিয়ে সব খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে, খসরু পারভেজ তারই সন্তান শীরুয়াহ (দ্বিতীয় কাভাদ) তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছে।” এসব ঘটনা শুনে বাজান ইবনে সান নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা দেন এবং তার সাথে তার আশে পাশে ইয়েমেনে যত পারসিক ছিল তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করে।
রোমান সম্রাটের নিকট দাওয়াত
সম্পাদনাহিজরি ১৯ সনে ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা উমার রোমানদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী পাঠালেন। এই বাহিনীতে আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহমীও ছিলেন, তিনি এই যুদ্ধে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের নিকট বন্দী হন। হিরাক্লিয়াস তাকে বহু লোভনীয় বস্তু এবং নির্যাতনের মাধ্যমে আবদুল্লাহকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আবদুল্লাহ তা অস্বীকার করেছিলেন। হিরাক্লিয়াস প্রথমে তাকে মুক্তি এবং বহু অর্থ দিয়ে সন্মানিত করার লোভ দেখান, কিন্তু আবদুল্লাহ এটা স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করেন। এরপর সম্রাট তাকে নিজের রাজত্বের ক্ষমতা ও নিজের মেয়েকে বিবাহ দেওয়ার লোভ দেখান, বিনিময়ে তাকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সম্রাট তখন লোভনীয় প্রস্তাব বাদ দিয়ে শারীরিক নির্যাতনের পথ বেছে নেয়।[৮]
সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাকে একটি শূলের কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেন হত্যা করার জন্য, এতেও আবদুল্লাহ তার ধর্ম পরিবর্তন করতে রাজি হননা। এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে তার সামনে অন্যান্য সাহাবাকে কড়াইয়ে উত্তপ্ত তেলে অনন্যা সাহাবাকে সিদ্ধ করার মতো নির্মম নির্যাতনের করেছিল। এবং আবদুল্লাহকেও উত্তপ্ত তেলে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছিলো। এছাড়াও আবদুল্লাহর বন্দীশালায় বেশ্যা পাঠিয়ে তার ধর্ম বিশ্বাসকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছিলো চেষ্টা করেছিলেন, হিরাক্লিয়াস তার সৈন্যদের দিয়ে তীর চালানোর আদেশ দিয়ে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আঘাত করেনি। এসমস্ত ভয়েও আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা ইসলাম ত্যাগ করেনি।[৯]
এরমধ্যে হিরাক্লিয়াস যখন অন্য সাহাবাকে আবদুল্লাহর সামনে উত্তপ্ত তেলে সিদ্ধ করলেন, তখন আবদুল্লাহ কাঁদছিলো, হিরাক্লিয়াস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি মৃত্যুভয়ে কাঁদছ? আবদুল্লাহ
জবাব দিয়েছিলো।[৮]
“ | তুমি আমাকে উত্তপ্ত তেলে ফেলে দিলে, আমি শুধু একবারই মারা যাবো। কিন্তু আমি ইসলামের পথে হাজার বার মারা যেতে চাই। এইজন্য আমি কাদছি। | ” |
রোমান সম্রাট থেকে মুক্তি
সম্পাদনাসম্রাট হিরাক্লিয়াসের সব লোভনীয় প্রস্তাব ও নির্মম শাস্তি সবকিছুই যখন ব্যর্থ হলো, তখন সম্রাট তাকে বলল, তুমি যদি আমার মাথায় একটি চুমো দাও, তাহলে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেবো। আবদুল্লাহ তখন বলল, আমি আপনার মাথায় চুমো দিতে পারি যদি আপনি আমার সাথীদের ছেড়ে দেন।[১০] তখন আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফার একটি চুমোর বিনিময়ে ৮০ মতান্তরে ৩০০ জন সাহাবা ছাড়া পায়।[১১] আবদুল্লাহ তার সাথীদের নিয়ে যখন মদিনায় খলিফা উমরের নিকট ফিরে এসে সবকিছু বললেন, আবদুল্লাহর সাহসিকতার কথা যখন পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব, সমস্ত মুসলমানকে আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফার কপালে চুমু খাওয়ার আদেশ দেন এবং প্রথম তিনি তার কপালে চুম্বন করেন।[১২][১৩][১৪]
হাদিস বর্ণনা
সম্পাদনাআবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা বেশ কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।[১৫] তন্মধ্যে একটি বুখারী শরিফে বর্নিত হয়েছে। যারা তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন তারা হলেন─আবু ওয়ায়িল, সুলাইমান ও ইবন ইয়াসার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যু
সম্পাদনাইবনে ইউনুস বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা মিসর অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং উসমানের খিলাফতকালে মিসরেই ইনতিকাল করেন, তাকে মিসরেই সমাহিত করা হয়।[১৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "সাহাবিদের জীবনের অনন্য ঘটনাবলি|165926|Desh Rupantor"। www.deshrupantor.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-১৩।
- ↑ Kandhalwi (Moulana.), Hadrat Muhammad Yusuf Sahib (১৯৬৪)। হায়াতুস সাহাবা (ইংরেজি ভাষায়)। ১। Idara Ishaàt Deenyaat। পৃষ্ঠা ৬৭।
- ↑ [হায়াতুস সাহাবা – ২/৩২১]।
- ↑ সিরাতু ইবনে হিশাম খণ্ড ২ পৃ.৬৪০
- ↑ সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৬৪০।
- ↑ [সিরাতু ইবন হিশাম – ২/৪৩০]।
- ↑ "সালেম মাওলা আবী হুজাইফা (রা)"। ইসলামিক অনলাইন মিডিয়া। ২০১৬-০৫-২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-১৩।
- ↑ ক খ "যে ঈমান ও আদর্শে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন সাহাবারা"। jagonews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-১৩।
- ↑ সহিহ বুখারী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ৯- (১ খন্ড)।
- ↑ আল-ইসতিয়ার, সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা – ১/৫১-৫৬।
- ↑ Mujahid, Abdul Malik (২০১২)। Golden Stories of Umar Ibn Al-Khattab। Darussalam। আইএসবিএন 9786035000994।
- ↑ [দ্রষ্টব্যঃ হায়াতুস সাহাবা – ১/৩০২]।
- ↑ Shaykh Muhammad Abdush Shakoor Farooqi Lakhnavi (r.a)। Usdul Ghabah Fi Marifat -us- Sahabah [r.a]। ৩।
- ↑ আল-ইসাবা-২/২৯৬-৯৭।
- ↑ ক খ [আল-ইসাবা – ২/২৯৬]।