আফ্রিদিরা (উর্দু:آفریدی‎) হলো বর্তমান পাকিস্তানের এক পাশতুন নৃগোষ্ঠী,যাদের কিছু অংশ আফগানিস্তানেও বসবাস করে। সরকার শাসিত নৃৃৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আফ্রিদিরাই সবচেয়ে প্রভাবশালী, যারা পেশাওয়ার এর পশ্চিমে স্পিন গড়ের পূর্বাঞ্চলে, খাইবার জেলা, পেশাওয়ার জেলা এবং কোহাট জেলার ১০০ বর্গ মাইল (৩০০০ বর্গ কিলোমিটার) এলাকাজুড়ে বাস করে।[২] তাদের এলাকার অন্তর্ভুক্ত খাইবার গিরিপথ এবং তিরাহের মইদান। ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও জম্মু ও কাশ্মীরেও আফ্রিদি অধিবাসী দেখা যায়।[৩]

আফ্রিদি
اپريدي
آفریدی
[১]
ভাষা
আফ্রিদি: পাশতু ভাষা
ধর্ম
সুন্নি ইসলাম
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী
Khattak· Orakzai· Wazir· Mehsuds
and other Karlani Pashtun tribes
চার্লস শেপার্ডের তোলা ছবিতে জামরুদ দুর্গে আফ্রিদিরা। জামরুদ দুর্গ বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার গিরিপথ এর পূর্ব প্রবেশ পথে অবস্থিত।

আফ্রিদিরা ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত বিদেশি যোদ্ধাদের হাত থেকে নিজেদের অবস্থান রক্ষা করার জন্য, বিশেষত মুঘল আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সৈন‍্য্যদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। তাদের পরবর্তী বর্বর যুুুুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে[৪]

পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর, আফ্রিদি নৃগোষ্ঠীরা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ১৯৪৭-এর সময় জম্মু ও কাশ্মীরে আক্রমণ করতে সাহায্য করে। আজ, আফ্রিদিরা পরিবহনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র ও যুদ্ধ উপকরণ ব‍্যবসার মাধ্যমে এফএটিএ-ও খাইবার পাখতুনখোয়া এলাকায় নিজেদের সামাজিক প্রভাবশালীতা ব‍্যবহার করে।

আফ্রিদিরা হলো পাশতুন,কার্লানী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অংশ,যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে ৩টি ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বিভিন্ন আফ্রিদি গোত্র একত্রিত হয়ে এবং কিছু গোত্র খাইবার রাইফেলের (ব্রিটিশ-ভারতের সৈন‍্যবাহিনী) অংশ হিসেবে ব্রিটিশদের পক্ষে গিয়েছিল।

আফ্রিদিরা আফ্রিদি পাশতু ভাষায় কথা বলে।

ব‍্যুৎপত্তি ও উৎস সম্পাদনা

আফ্রিদি,যাদের সাধারণভাবে Abaörteans ( (/ˌæbə.ɔːrˈtiːənz/; লাতিন:Abaortae) বলা হয়, তাদের মূল বাসভূমি খাইবার এজেন্সির তিরাহ-য়।

পাশতুন লোকাচার অনুসারে, তাদের পূর্বপুরুষ কোয়াইশ আব্দুর রশিদ এর কনিষ্ঠ পুত্র কারলানের থেকে আফ্রিদি নৃগোষ্ঠীর মূল উৎস এসেছে। একারণেই, আফ্রিদি নৃগোষ্ঠীরা কার্লান নৃগোষ্ঠীর একটি অংশ।

প্রাচীন পাশতুনের উপজাতি সম্পাদনা

হিরোডোটাস পাখতাসের একটি নৃগোষ্ঠীকে Aparytai (Ἀπαρύται) হিসেবে উল্লেখ করেন।[৫] ভাষাবিদ‍্যা ও ভৌগোলিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পণ্ডিত গ্রিয়েরসন, স্টেইন, ওলাফ ক‍্যারো এই নৃগোষ্ঠীকেে আধুনিক আফ্রিদি হিসেবে তুলনা করেন।

গোত্র সম্পাদনা

আফ্রিদি নৃগোষ্ঠীকে আটটি উপজাতিতে ভাগ করা হয়। যথা:

  • কুকি খেল
  • মালিক দীন খেল
  • কোয়াম্বার খেল
  • কামার খেল
  • জাখা খেল
  • আকা খেল
  • সেপাহ্
  • আদম খেল

সকল আফ্রিদি গোত্রের নিজস্ব এলাকা আছে তিরাহ উপত‍্যকায়। মালিক দীন খেল বসবাস করে তিরাহ এর কেন্দ্রে। আকা খেলরা বাস করে জামরুদের দক্ষিণ পার্বত্য অঞ্চলে। এই এলাকাগুলো খাইবার এজেন্সিতে অবস্থিত। আদম খেলরা বাস করে পেশাওয়ার ও কোহাট এর পাহাড়ে। বুর্কিরা অবস্থান করে কানিগোরাম উপত্যকা, ওয়াজিরিস্তান ও পেশাওয়ারে। তাদের বসবাস হলো কোহাট গিরিপথে যেখানে আফ্রিদিদের গুরুত্বপূর্ণ বন্দুক কারখানা অবস্থিত।

ধর্ম সম্পাদনা

আধুনিক আফ্রিদিদের ধর্ম হলো ইসলাম। তারা সুলতান মাহমুদ গজনভি এবং হারুন রশীদের মতানুসারে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।[৬]

ইতিহাস সম্পাদনা

মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পাদনা

আফ্রিদি এবং তাদের নৃগোষ্ঠী খলিল প্রথম উল্লিখিত হয়েছে মুঘল সম্রাট বাবর এর বাবরনামায়। আফ্রিদি নৃগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছিল খাইবার গিরিপথ যা ভারতীয় উপমহাদেশ এর প্রবেশদ্বার ছিল। আফ্রিদিদের প্রতিকূলতার। তাই, এই এলাকায় রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনেক।[৭]

সম্পূর্ণ মুঘল আমলজুড়ে, সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর উভয়ই আফ্রিদিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও খুব অল্প সফল হয়েছিলেন।

আফ্রিদিরা একদা সম্রাট আওরঙ্গজেব এর দুুটি বড় সৈন্যবাহিনী ধ্বংস করেছিল, প্রথমবার ১৬৭২ সালে পেশাওয়ার ও কাবুল এর আচমকা আক্রমণে, দ্বিতীয়বার ১৬৭৩ সালের শীতে পার্বত্য গিরিপথে। সম্রাট নিজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে, আরও একটি সৈন্যবাহিনী বাজাউরে 'বাজেভাবে ব্যর্থ' হয়।[৮]

কোনোভাবে, পাঁচজন মুঘল এই যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসে।

 
জন বুর্কের তোলা ১৮৭৮ সালে আফ্রিদি যোদ্ধাদের ছবি
 
১৮৯৫ সালে খাইবার রাইফেল এর আফ্রিদি কর্মকর্তা

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পাদনা

পেশাওয়ার ও কোহাট জেলা আত্মসাতের পর আদম খেলদের সাথে ব্রিটিশদের সম্পর্কের সূচনা হয়। এরই সূত্র ধরে ব্রিটিশরা এলাকাটি রক্ষার জন্য তাদের অর্থ প্রদান করা শুরু করে। যাহোক, ১৮৫০ সালে, আফ্রিদিরাই আবার তাদের বিরুদ্ধে রাস্তা নির্মাণে লিপ্ত কিছু ব্রিটিশদের উপর হামলা চালায় ও ১২ জনকে নিহত এবং ৬ জনকে আহত করে। এরপর ব্রিটিশরা ৩২০০ জন সৈন্য নিয়োগ করে ও তাদের শাস্তি প্রদান করে।[৯]

১৮৫৪ সালে,আকা খেল আফ্রিদিরা কোহাট গিরিপথে নিজেদের প্রবেশের দাবিতে প্রতিরোধ করে ও ব্রিটিশ ক্যাম্পে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে, ১৫০০ ব্রিটিশ সৈন্য তাদের উপর অত্যাচার ও জরিমানা চালায়।

১৮৭৭ সালে, ব্রিটিশ সরকার কোহাটে জোয়াকি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রবেশাধিকার কমালে, তারা টেলিগ্রাফের তার কাটা ও ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ এর মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করে। তাই ব্রিটিশরা জোয়াকি আন্দোলনে ১৫০০ সেনা লিপ্ত করে জোয়াকি আফ্রিদিদের উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু, জোয়াকি এরপরও আন্দোলন চালালেও, ব্রিটিশরা ৩ ভাগে ৭৪০০ জন সৈন্যকে নিয়ে ১৮৭৭-৭৮ সালে তাদের প্রধান গ্রামগুলোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে, তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ও ব্রিটিশরা এলাকাটিকে মুক্ত করে।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ এর সময়, ১৮৭৮ সালে, জাকা খেলরা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল এবং আফ্রিদিরা খাইবার গিরিপথ এলাকায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়়ে তোলে। ২৫০০ সেনার এক সৈন্যবাহিনী দেশটিতে প্রবেশ করে। কিন্তু, আফ্রিদিদের প্রতিরোধের জন্য ব্রিটিশদের ৩৭৫০ সেনার সৈন্যবাহিনী আফগান যুদ্ধে লিপ্ত করে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে হারার পর, নৃগোষ্ঠীরা আত্মসমর্পণ করে।

১৮৯৭ সালে,আফ্রিদিরা পুনরায় জাগ্রত হয়ে,খাইবারের সকল ব্রিটিশ পোস্ট দখল করে, পেশাওয়ারের সামানা রেঞ্জের দুর্গে আক্রমণ করে। কিন্তু, ১৮৯৮ এর বসন্তে, তিরাহ আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা অস্ত্র সমর্পণ করে ও জরিমানা প্রদান করে।

১৯০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে পুনরায়,জাক্কা খেলরা বাজার উপত্যকায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালালেও, দ্রুত তারা ব‍্যর্থ হয়।

রন্ধনশাস্ত্র সম্পাদনা

মাংস, আফ্রিদিদের খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ,যা তারা প্রায়ই কাবাব , ভেড়ার কারি, চিকেন কারি অথবা ছাগলের কারি হিসেবে খায়। পেশাওয়ার নামাক মান্দি বাজারের হোটেলে আফ্রিদিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায়। নিরামিষ খাবারের মধ্যে, ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রন্ধনশৈলীর উপকরণ, ভিন্ডি (ঢেঁড়শ), রাজমা, মসুর ডাল ,শাক (পালং শাক) উল্লেখযোগ্য।[১০]

উল্লেখযোগ্য আফ্রিদি ব্যক্তিত্ব সম্পাদনা

 
শহীদ আফ্রিদি , ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Afridi demographics in Pakistan and Afghanistan ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে The excessive figure sometimes mentioned in Afghanistan reflects in a particular way the Afghan claim to Pashtunistan and actually represents an estimate of the whole of the Afridi tribe on both sides of the frontier.
  2. "Afridi demographics in FATA and FR Kohat"। ১৭ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  3. "Study of the Pathan Communities in Four States of India"। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. Thomas, L. (১৯২৫)। Beyond Khyber Pass 
  5. ""The History of Herodotus Chapter 3, Verse 91; Written 440 B.C.E, Translated by G. C. Macaulay"" 
  6. History of the Pathans by Haroon Rashid Published by Haroon Rashid, 2002 Item notes: v. 1 Page 45 Original from the University of Michiga 
  7. "History of Khyber Agency: Gateway to the Subcontinent"। ১৩ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  8. "Khyber Agency"। ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  9. "Afridi People | Brittannica" 
  10. "EnWiki-Afridi" 
  11. "ODI Records:- Fastest 100s" 
  12. "Yuvraj Singh vs Shahid Afridi | Who's The Greatest?"