আনোয়ার উল আলম শহীদ হলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, রাষ্ট্রদূত এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলে আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনী কাদেরিয়া বাহিনীতে তার ভূমিকা অনন্য। স্বাধীনতার পর সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে। তিনি এই বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন এবং বাহিনীর গঠন-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এর সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হলে তিনি সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পুনর্নিয়োগ পান। এর কয়েকবছর পর তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। তিনি বাহরাইনস্পেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।[]

আনোয়ার উল আলম শহীদ
বেসামরিক প্রধান
কাদেরিয়া বাহিনী
কাজের মেয়াদ
মে ১৯৭১ – জানুয়ারি ১৯৭২
নিয়োগদাতাআবদুল কাদের সিদ্দিকী
ডেপুটিহামিদুল হক বীরপ্রতীক
পূর্বসূরীবাহিনী গঠিত
উত্তরসূরীবাহিনী বিলুপ্ত []
উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ)
জাতীয় রক্ষীবাহিনী
কাজের মেয়াদ
৪ মে ১৯৭২ – ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫
নিয়োগদাতাশেখ মুজিবুর রহমান
পূর্বসূরীবাহিনী প্রতিষ্ঠা
উত্তরসূরীবাহিনী বিলুপ্ত
বাহরাইনস্পেনে নিযুক্ত
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ'৭১
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম১৯৪৭
টাঙ্গাইল, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ)
মৃত্যু১০ ডিসেম্বর ২০২০
ঢাকা
দাম্পত্য সঙ্গীডা. সাঈদা খান
পিতামৌলভী আবদুর রাহীম ইছাপুরী
প্রাক্তন শিক্ষার্থীঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সামরিক পরিষেবা
শাখাবাংলাদেশ সেনাবাহিনী
কাজের মেয়াদ১৯৭৫-১৯৭৮
পদকর্নেল
যুদ্ধবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
পুরস্কার[]

জন্ম ও পরিবার

সম্পাদনা

আনোয়ার উল আলম ১৯৪৭ সালে তৎকালীন মহকুমা শহর টাঙ্গাইলের থানাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আশুরার দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে ডাকনাম রাখা হয় শহীদ এবং বড়বোনের স্বামী ঠিক করে দেন ভালো নাম- "আনোয়ার উল আলম"। তিনি পিতা-মাতার অষ্টম সন্তান। তাঁর পিতা মৌলভী আবদুর রাহীম ইছাপুরী ছিলেন পরহেজগার, বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিত, বাগ্মী ও টাঙ্গাইলে ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনের কারণে পাকিস্তানি শাসকরা তাঁকে বৃদ্ধ বয়সেও কারারুদ্ধ করে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের তৎকালীন কালিহাতী থানার ইছাপুর গ্রামে এবং কয়েক পুরুষ আগে নিবাস ছিল সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়ায়। টাঙ্গাইল শহরে তাদের বাড়ির নাম ইছাপুরী লজ, যেখানে তাঁরা ১৯৪৮ সালে বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখের সাথে মৌলভী ইছাপুরীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ শহীদের ফুফাতো বোনের স্বামী। []

শিক্ষাজীবন ও রাজনীতি

সম্পাদনা

আনোয়ার উল আলমের পরিবারের অনেকে দেশের মুক্তির জন্য, গণমানুষের রাজনীতি করেছেন। এমন রাজনীতিমনস্ক পরিবারের ছেলে হিসেবে তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এখান থেকেই তিনি এম.এ. পাস করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আনোয়ারুল আলম শহীদ। এসময় বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের সাথে তাঁর পরিচয় গড়ে উঠে। [][]

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

সম্পাদনা

২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা আনোয়ারুল আলম শহীদ মাইকযোগে সমগ্র টাঙ্গাইল শহরে প্রচার করেন। ২৬ মার্চ টাঙ্গাইল থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ, যেমন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান ফারুক, বদিউজ্জামান খান প্রমুখের নেতৃত্বে স্থানীয় নেতা-কর্মী, ইপিআর সদস্য এবং সাধারণ ছাত্র-যুবকরা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ৩ এপ্রিল পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশ পথে গুড়ান সাটিয়াচড়া নামক স্থানে এসে পৌঁছলে তুমুল প্রররোধের সম্মুখীন হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ছাত্র যুবক ও ইপিআরের প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙ্গে পড়ে। ৬ জন ইপিআর ও ছাত্রলীগ নেতা জুমরাতসহ ৩৩৭ জনকে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে এবং অনেক শহরের বাড়ি গ্রাম আগুনে ভস্মীভূত করে। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে সর্বাধিনায়ক করে গড়ে উঠে টাঙ্গাইলের বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী। কাদেরিয়া বাহিনী গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আনোয়ার উল আলম সার্বক্ষনিকভাবে তার সাথে থেকে এই বাহিনী গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মে মাসে সখিপুরের মহানন্দপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। আনোয়ারুল আলম শহীদকে বাহিনীর বেসামরিক প্রধান ও হামিদুল হককে উপ-প্রধান নিয়োগ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি সাপ্তাহিক মুখপাত্র রণাঙ্গন প্রকাশিত হতে থাকে। রণদূত ছদ্মনামে আনোয়ার উল আলম শহীদ এই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সহ-সম্পাদক ছিলেন ফারুক আহমদ ও সৈয়দ নূরুল ইসলাম। বেসামরিক প্রধানকে সহায়তা করার জন্য সৈয়দ নূরুল ইসলাম,ফারুক আহমদ ও আব্দুল্লাহ কে বেসামরিক প্রধানের বিশেষ সহকারী নিয়োগ করা হয়। টাঙ্গাইল ও সন্নিহিত জেলাসমূহের অংশসহ কাদেরিয়া বাহিনী এক বিশাল মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। এরা ছিল এই অঞ্চলে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের জন্য মূর্তিমান ত্রাস।

ধলাপাড়ার যুদ্ধে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য আবদুল কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে যান। ভারতে অবস্থানকালে কাদের সিদ্দিকী মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। তাই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আনোয়ার উল আলম শহীদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল মুজিবনগর গমন করেন। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের অতি আগ্রহ নিয়ে যুদ্ধের খবর নেন। থিয়েটার রোডে বিশেষ মন্ত্রিপরিষদের সভায় তাদের স্বাগত জানানো হলে আনোয়ার উল আলম শহীদ টাঙ্গাইলের যুদ্ধ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং জানান কীভাবে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের এতো অভ্যন্তরে থেকে সুপরিকল্পিত উপায়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছে।বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সংবাদ বেতারে প্রচার করতে নির্দেশ দেন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান আব্দুল মান্নান এমএনএ ও চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুল এর তত্ত্বাবধানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেশে-বিদেশে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের সফল কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী যুদ্ধকৌশল ও যুদ্ধপরিকল্পনা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাঁর কামরায় টাঙ্গানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা সংবলিত মানচিত্র দেখিয়ে তাকে (শহীদকে) বলেন, আমার মনে হয়, কাদের সিদ্দিকী উইল বি দ্যা ফার্স্ট ম্যান টু রীচ ঢাকা। উল্লেখ্য যে, এমএজি ওসমানীর এই ভবিষ্যদ্বাণী এক মাস পর ঠিক ঐ একই তারিখে (১৬ ডিসেম্বর) অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো।

বিজয়েরবপর ১৮ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন রাজধানীতে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী প্রথম জনসভা করেন। সেই জনসভায় অন্যদের সাথে আনোয়ার উল আলম (শহীদ)ও বক্তৃতা করেন এবং ঢাকাবাসীকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করলে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ও আনোয়ার উল আলম (শহীদ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এরপর ২৪ জানুয়ারি,১৯৭২ সালে কাদেরিয়া বাহিনী সামরিক কায়দায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করে। [][]

রক্ষীবাহিনী ও কর্মজীবন

সম্পাদনা

রক্ষীবাহিনী গঠনে ভূমিকা

সম্পাদনা
  • ২৪ জানুয়ারি সরকার সাবেক ইপিআরমুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করার প্রেসনোট জারি করে। বঙ্গবন্ধু আনোয়ার উল আলমকে ডেকে পাঠান এবং তাই তিনি ১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারি গণভবন যান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকায় থাকতে এবং মেজর এ এন এম নূরুজ্জামানের সাথে দেখা করতে বলেন।
  • ৩১ জানুয়ারি জাতীয় মিলিশিয়ার নবনিযুক্ত পরিচালক মেজর নূরুজ্জামানের সাথে আনোয়ারের পরিচয় হয় এবং বঙ্গবন্ধুর আদেশে তিনি ও সারোয়ার হোসেন মোল্লা জাতীয় মিলিশিয়ার সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁরা তিনজন একদম শূন্য থেকে, শত প্রতিকূলতার মধ্যে একটি বাহিনী গড়ে তুলতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
  • পরবর্তীতে ইপিআরকে বিডিআর হিসেবে পুনর্গঠন করা হয় এবং মুক্তিবাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পৃথকভাবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী (জেআরবি) গড়ে তোলা হয়। রক্ষীবাহিনীর এ. এন. এম. নূরুজ্জামান পরিচালক এবং আনোয়ার উল আলম শহীদ ও সারোয়ার হোসেন মোল্লা সহকারী পরিচালক হিসেবে পুনর্নিয়োগ পান।

রক্ষীবাহিনীতে চাকরিজীবন

সম্পাদনা
  • সহকারী পরিচালক হিসেবে আনোয়ারের উপর প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের দায়িত্ব পড়ে, বিশেষ করে বিভিন্ন পর্যায়ের রক্ষী সদস্যদের বেতন-ভাতা ঠিক করার কাজ।
  • ১৯৭২ সালের ৪ মে আনোয়ার উল আলম উপপরিচালক (লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায়) হিসেবে পদোন্নতি পান। তাঁকে প্রশিক্ষণ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের জোনাল কমান্ডার করা হয়।
  • ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁকে "জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কোর্সে" ছয় মাসের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে দেশে ফিরে আসেন৷ এবার শুধু উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) হিসেবে দায়িত্ব পান এবং তাই সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব তাঁর উপর থাকে। বাহিনীর বিলুপ্তি পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন।

[]

উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড

সম্পাদনা
  • আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানা থেকে নির্বাচিত সাংসদ৷ একই থানার নাগবাড়ী গ্রামে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিশাল পৈতৃক বাড়ি। ১৯৭৪ সালের কোন এক সময় সেই বাড়ি সাংসদ জোরপূর্বক দখল করে নেন। দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে জানান। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং আনোয়ার উল আলমকে বাড়িটি দখলমুক্ত করার আদেশ দেন। তিনি ময়মনসিংহ ক্যাম্প থেকে দুই ট্রাক রক্ষী সদস্য নিয়ে গভীর রাতে সেই বাড়িতে অপারেশন চালান। অন্য কোন রাজনৈতিক নেতা, এমনকি পুলিশের অগোচরে অপারেশন চালিয়ে বাড়িটি দখলমুক্ত করা হয়।
  • ১৯৭৪ সালে জিয়াউর রহমানকে পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত হয়। মনে করা হয়, নিজের সেনাপ্রধান হওয়ার পথ সুগম করার জন্য খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর কাছে জিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলে এটা করিয়েছিলেন। আনোয়ার উল আলমের সাথে খালেদা জিয়ার বড়বোন খুরশীদ জাহান হকের পারিবারিক পরিচয় ছিল। সেইসূত্রে জিয়া আনোয়ারের সাথেও যোগাযোগ করেন। সরাসরি সুপারিশ করতে না পারলেও তাঁর পরামর্শমতো অগ্রসর হয়ে জিয়া সেইযাত্রায় বদলি ঠেকাতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে দেখা যায় এর কারণে জিয়ার ক্ষমতায় যাওয়ার একটা পথ উন্মুক্ত হয় এবং আনোয়ার উল আলম নিজের বইয়ে এই নিয়ে আফসোস করেছিলেন। []

১৫ আগস্ট পরবর্তী ভূমিকা

সম্পাদনা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন এবং বঙ্গবন্ধুকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে না পারা ও হত্যার পরে খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থতার জন্য রক্ষীবাহিনীকে আজও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা থাকায় আনোয়ার উল আলম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এসময় বিদেশে ছিলেন এবং হত্যার পর আনোয়ার উল আলমরা খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাদের সাড়া না পাওয়ায় এবং পর্যাপ্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ ও ঢাকায় যথেষ্ট রক্ষী সদস্য না থাকায় তাঁদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঢাকা থেকে বের হয়ে অন্য অঞ্চল থেকে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৫ আগস্ট সকল বাহিনী প্রধান রেডিও স্টেশনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দ্বারা নতুন রাষ্ট্রপতি হওয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। পরিচালকের অনুপস্থিতিতে আনোয়ার ও সারোয়ারকে একই কাজ করতে হয়।[]

সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ

সম্পাদনা

১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর সরকার রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই নিয়ে সরকারে দুটি বিপরীত মত দেখা দেয়- খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম এ জি ওসমানী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে ভাগ করে দেওয়ার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেন; অন্যদিকে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত সকল সদস্যদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের পক্ষে অবস্থান নেন। আনোয়ার উল আলম এসময় সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের পক্ষে ছিলেন এবং পুরো আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ও সারোয়ার হোসেন মোল্লা বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ও সরকারের সেসনা বিমানে সারাদেশে রক্ষীবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে সর্বস্তরের সদস্যের মতামত নেন। অবশেষে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। এই অবলুপ্তির লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ৯ অক্টোবর তারিখে সরকারি আদেশ প্রকাশ করা হয়। এই আদেশে বলা ছিল যে ১৯৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় রক্ষীবাহিনী অবলুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে। ১৫ অক্টোবর তিনি সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে যোগদান করেন। কার্যত ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে জ্যেষ্ঠতা গণ্য করা হয়। []

সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন

সম্পাদনা

সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর সারোয়ার ও তাঁকে তখন কুমিল্লায় অবস্থিত বাংলাদেশ সামরিক একাডেমিতে ওরিয়েন্টেশন কোর্সের জন্য পাঠানো হয়। ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর সেখানে যোগদান করেন। ৩ নভেম্বর সংঘটিত খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন সেনা-অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন এবং এতে তিনি সমর্থনও করেন। তবে সেসময় কুমিল্লায় থাকায় অভ্যুত্থানে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু এটাই তাঁর জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়, কারণ খালেদ মোশাররফ সহ অভ্যুত্থানের বেশ কয়েকজন নেতা নিহত হন এবং অন্যদের পরিণতিও ভালো হয়নি। এর কিছুদিন পর তাঁকে সেনাবাহিনীর নতুন চিফ অব জেনারেল স্টাফ মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের অধীনে জিএস ব্রাঞ্চে বদলি করা হয়। পরে তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কয়েকবছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর ১৯৭৮ সালে অবসর দিয়ে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।[] []

কূটনীতিক জীবন

সম্পাদনা

১৯৭৯ সালের দিকে আনোয়ার উল আলম জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। জাকার্তা থেকে বদলি হয়ে যান কুয়ালালামপুরে, কুয়ালালামপুর থেকে তিনি যান ব্রুনাই। সেখান থেকে বদলি হয়ে যান হংকং। চাকরিজীবনের শেষ দিকে তিনি অতিরিক্ত সচিব, সচিব মর্যাদায় বাহরাইনস্পেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হন। []

পরবর্তী জীবন

সম্পাদনা

আনোয়ারুল ২০০৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। এছাড়া তিনি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ '৭১ এর সহ-সভাপতি৷ আর তাঁর স্ত্রী স্থাপন করেছেন তাঁদের গ্রাম ইছাপুরে একটি ক্লিনিক। ১০ ই ডিসেম্বর ২০২০ সালে মস্তিষ্কে অপারেশন পরবর্তী অবস্থায় করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত হন এবং কোভিড শক সিনড্রোমে মৃত্যু বরন করেন। []

শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

সম্পাদনা

অবসর গ্রহণের পর শহীদ টাঙ্গাইল শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৈতৃক ভিটায় দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এই ভবনের নিচতলাতেই গড়ে তুলেছেন জাদুঘর। নাম শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ২০১০ সালে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এই জাদুঘর যাঁরা দেখতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ প্রজন্মের। দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্টজনও জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। বাসায় থাকলে আনোয়ারুল নিজে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখান জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারক। ছবি দেখিয়ে বর্ণনা করেন যুদ্ধদিনের ইতিহাস।

নিচতলাজুড়ে সাজানো মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত একুশের সংকলন, আন্দোলন-সংগ্রামে দিকনির্দেশনা দিয়ে জেলার নেতাদের লেখা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতার চিঠি, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন বীরত্ব থেকে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র। আরও রয়েছে যুদ্ধ চলাকালীন ও বিজয়ের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদনের ছবি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চল থেকে আনোয়ারুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত রণাঙ্গন পত্রিকার কপি, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দলিল, টাঙ্গাইল অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ভারতীয় বাহিনীর প্যারাসুট, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকিস্তানি জাহাজের অংশবিশেষসহ অন্যান্য স্মারক। []

রচিত গ্রন্থ

সম্পাদনা

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: জুন ২০১৩

প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯ [][]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৬ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০২০ 
  2. রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ:জুন ২০১৩। ISBN 978 984 90253 9 9
  3. September 14, মহিউদ্দিন আহমদ; PM, 2013 at 11:34। "রক্ষীবাহিনী: সত্যকথন ও দায় স্বীকার"www.prothomalo.com 
  4. একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময়। লেখক:আনোয়ার উল আলম শহীদ। প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
  5. https://www.prothomalo.com/amp/bangladesh/article/1629503[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. "'পাকিস্তানি ১৯৫ সেনার বিচার-ক্ষতিপূরণ আদায়ে জাতিসংঘে দাবি জানাতে হবে'"সমকাল [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  7. https://www.prothomalo.com/amp/bangladesh/article/162950[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. "একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় - আনোয়ার উল আলম শহীদ"www.rokomari.com