আনন্দীবাঈ জোশী

(আনন্দীবাঈ যোশী থেকে পুনর্নির্দেশিত)

আনন্দীবাঈ গোপালরাও জোশী (মারাঠি: आनंदीबाई गोपाळराव जोशी) (জন্ম : ৩১ মার্চ, ১৮৬৫- মৃত্যু : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৭) ভারতের প্রথম নারী চিকিৎসক।[১] তিনি ছিলেন প্রথম হিন্দু নারী, যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষার্জনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা করেন।[২][৩]

আনন্দীবাঈ গোপালরাও জোশী
জন্ম
যমুনা জোশী

(১৮৬৫-০৩-৩১)৩১ মার্চ ১৮৬৫
কল্যাণ
মৃত্যু২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭(1887-02-26) (বয়স ২১)
কোলাপুর
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়
পেশাচিকিৎসক
দাম্পত্য সঙ্গীগোপালরাও বিনায়ক জোশী

প্রথম জীবন সম্পাদনা

আনন্দীবাই ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে মার্চ ব্রিটিশ ভারতের থানে জেলার অন্তর্গত কল্যাণ গ্রামের এক রক্ষণশীল সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গণপতরাও অম্রুতেশ্বর জোশী। শৈশবে তার নাম ছিল যমুনা। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র নয় বছর বয়সে ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক বিপত্নীক ডাকবিভাগে কর্মরত গোপালরাও বিনায়ক জোশীর সাথে তার বিবাহ দেওয়া হয়। বিয়ের পর তার নাম রাখা হয় আনন্দী। কোলাপুরে থাকাকালীন তিনি একটি সন্তানের জন্ম দিলেও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়।[৪]

গোপালরাও একজন নারী শিক্ষার সমর্থক প্রগতিশীল ব্যক্তি ছিলেন, যা তৎকালীন যুগে ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজে খুব একটা সুলভ ব্যাপার ছিল না। গোপাল হরি দেশমুখের শত পত্রে নামক রচনা দ্বারা প্রভাবিত গোপালরাও সংস্কৃত অপেক্ষা ইংরেজি শিক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হন। স্বামীর তত্ত্বাবধানে আনন্দীর শিক্ষালাভ শুরু হয়। কোলাপুরে আনন্দী কিছুদিনের জন্য মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেও সামাজিক বাধায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন।[৪] চৌদ্দ বছর বয়সে আনন্দী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু মাত্র দশ দিনের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার ফলে আনন্দীর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র পাঠের ব্যাপারে আগ্রহের সৃষ্টি হয়।[৩]

চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রস্তুতি সম্পাদনা

 
আনন্দীবাঈ জোশী

তাদের সন্তানের মৃত্যু হলে গোপাল বিদেশের সংবাদপত্রে তার স্ত্রীর চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আবেদন শুরু করেন। প্রায় দুই বছর পরে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন রেভারেন্ড ওয়াইল্ডারকে লেখা তার চিঠি ক্রিশ্চিয়ান রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হলে থিওডোরা কার্পেন্টার নামে এক মার্কিন মহিলার নজরে আসে। শিক্ষালাভের ব্যাপারে আনন্দীর আগ্রহ এবং স্ত্রীকে গোপালরাওয়ের উৎসাহ তাকে মুগ্ধ করে। থিওডোরা পত্রে আনন্দীবাঈকে আমেরিকায় শিক্ষালাভের ব্যাপারে সব রকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। কলকাতা শহরে থাকার সময় আনন্দীবাঈয়ের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। থিওডোরা তাকে আমেরিকা থেকে ঔষধ প্রেরণের ব্যবস্থা করলেও তা খুব একটা ফলপ্রদ হয়নি। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে গোপালরাও কার্যসূত্রে শ্রীরামপুর শহরে বদলি হলে তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য আনন্দীবাঈকে একা আমেরিকা পাঠিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের ব্যাপারে রাজি করান। থরবর্ন নামক এক চিকিৎসক দম্পতি তাকে উইমেন'স মেডিক্যাল কলেজ অব পেনসিলভেনিয়াতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আনন্দীর বিদেশযাত্রার বিরোধিতা করে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তার সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকলেও আনন্দীকে তারা ধর্মান্তরিত করতে উৎসাহী ছিলেন। আনন্দীবাঈ শ্রীরামপুর কলেজে একটি সভায় তার আমেরিকা যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ভারতে একজন হিন্দু মহিলা চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি এই সভায় খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত না হওয়ার শপথও নেন। তিনি ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই এপ্রিল চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হন।[৪]

আমেরিকায় চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা সম্পাদনা

 
১৮৮৫ সালের ১০ অক্টোবর তোলা একটি স্থিরচিত্রে সাবাত ইসলামবুলি (ডানে) ও কেই ওকামির (মাঝে) সাথে আনন্দীবাঈ জোশী (বামে)

১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে আনন্দী নিউ ইয়র্ক পৌঁছন। সেখানে থিওডোরার সাহায্যে তিনি উইমেন'স মেডিক্যাল কলেজ অব পেনসিলভেনিয়াতে ভর্তি হন[৫] এবং ঐ কলেজের অধ্যক্ষা র‍্যাচেল বডলের সাহায্যে একটি বৃত্তি পেয়ে যান। আমেরিকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে, শীতের প্রকোপে ও অপুষ্টিতে কঠিন পরিশ্রম করে আনন্দী যক্ষ্মা রোগের কবলে পড়েন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ আনন্দীবাঈ চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক লাভ করেন।[৪]

১৮৮৫ সালের ১০ অক্টোবর মেডিকেল কলেজে অধ্যায়নের সময় অনুষদ ডিনের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে গৃহীত স্থিরচিত্রটি আনন্দীবাইয়ের একটি প্রচলিত ঐতিহাসিক ছবি। এছবিতে তাকে কেই ওকামিসাবাত ইসলামবুলির সাথে নিজ অঞ্চলের সংস্কৃতি অনুযায়ী উপস্থাপিত পোশাকে দেখা যায়। চিত্রের প্রত্যেক নারী- আনন্দী ভারতের, কেই জাপানের এবং সাবাত সিরিয়ার তথা নিজ দেশের প্রথম নারী যারা পাশ্চাত্যের বিদ্যালয় হতে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক অর্জন করে চিকিৎসক হয়েছিলেন।[৬][৭]

অসুস্থতা ও মৃত্যু সম্পাদনা

ডিগ্রী লাভের পর কোলাপুর রাজ্যের কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ পেলে তিনি দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পরে অসুস্থ অবস্থায় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর বোম্বাই ফিরে এসে হাসপাতালে কাজে যোগদান করেন। কাজে যোগদান করার কিছু দিনের মধ্যেই আনন্দী পুনরায় অসুস্থ হয়ে কিং অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিন্তু কালাপানি পেরিয়ে আসা জাতিচ্যুত আনন্দীকে তার সহকর্মী এবং অন্যন্য চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন। বিনা চিকিৎসায় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি রাত দশটায় আনন্দীবাঈয়ের মৃত্যু হয়।[৪] তার ভস্মাবশেষ থিওদোরার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা তিনি তার পারিবারিক সমাধিতে স্থাপন করেন।

কিংবদন্তি সম্পাদনা

ক্যারোলিন হেলী ডাল ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দীবাঈয়ের জীবনী রচনা করেন।[৮] শ্রীকৃষ্ণ জনার্দন জোশী আনন্দীবাঈয়ের জীবন নিয়ে আনন্দী গোপাল নামক মারাঠি ভাষায় একটি কাল্পনিক উপন্যাস রচনা করেন, যা আশা দামলে পরবর্তীকালেন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন।[৯] রাম জোগলেকর এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন দূরদর্শন আনন্দীবাঈয়ের জীবনের ওপর আধারিত আনন্দী গোপাল নামক একটি হিন্দি ধারাবাহিক সম্প্রচার করে।[১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Eron, Carol (১৯৭৯)। "Women in Medicine and Health Care"। O'Neill, Lois Decker। The Women's Book of World Records and Achievements। Anchor Press। পৃষ্ঠা 204আইএসবিএন 0-385-12733-2First Hindu Woman Doctor 
  2. "Historical Photos Depict Women Medical Pioneers"। Public Radio International। ১২ জুলাই ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০১৩ 
  3. "ANANDIBAI JOSHI India's first woman doctor (1865 – 1887)"Horizon - KIET Education। ২০০৯-১০-০৭। ২০০৯-১০-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-৩০ 
  4. মহিলা ডাক্তার - ভিন গ্রহের বাসিন্দা - চিত্রা দেব, প্রথম সংস্করণ, আইএসবিএন ৮১-৭২১৫-২৮৩-৩
  5. Scan of letter ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে from Anandibai Joshi to Alfred Jones, 28 June 1883; DUCOM Archives
  6. রাও, মল্লিকা (৮ এপ্রিল ২০১৪)। "Meet The Three Female Medical Students Who Destroyed Gender Norms A Century Ago" (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০২৪হাফপোস্ট-এর মাধ্যমে। 
  7. "A memento of the Dean's reception, held Oct 10, 1885"ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার আর্কাইভ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-৩০ 
  8. The Life of Dr. Anandabai Joshee: A Kinswoman of the Pundita Ramabai ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে, published by Roberts Brothers, Boston
  9. "Archived copy"। ২৭ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ এপ্রিল ২০১৮ 
  10. "Who is Anandi Gopal Joshi to whom Google dedicated a Doodle?"India Today (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০১৮ 

আরো পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা