আতাইকুলা গণহত্যা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাঙালি হিন্দুদের উপর হত্যাকান্ড

আতাইকুলা গণহত্যা (ইংরেজি: Ataikula massacre) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় চিহ্নিত রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি দখলদারি সেনাবাহিনী দ্বারা  বাংলাদেশের পাবনা জেলার আতাইকুলা গ্রামের বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর সংগঠিত হত্যাকান্ডকে বোঝায়। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল সকাল ৯টা হতে বিকেল ৬টা পর্যন্ত সামরিক বহর সহ ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনা হত্যালীলা চালায়। ৫২ জন হত্যাকাণ্ডে মারা যান।[১]

আতাইকুলা গণহত্যা
আতাইকুলা গণহত্যা বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
আতাইকুলা গণহত্যা
স্থানরাজশাহী বিভাগ, পাবনা জেলা, বাংলাদেশ
স্থানাংক২৪°০২′ উত্তর ৮৯°২৫′ পূর্ব / ২৪.০৩° উত্তর ৮৯.৪১° পূর্ব / 24.03; 89.41
তারিখ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ (ইউটিসি+৬:০০)
লক্ষ্যবাঙ্গালী হিন্দু
হামলার ধরনগণহত্যা
ব্যবহৃত অস্ত্ররাইফেল
নিহত৫২ জন
হামলাকারী দলপাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার

নওগাঁ নাটোর এলাকার এম.পি শাহিন মনোয়ারা হক জাতীয় সংসদে আতাইকুলা গ্রামের গনহত্যার ঘটনাকে জাতীয় সংসদকে অবহিত করেন। ১৯৯৭ সালের ১ লা অক্টোবর শাহিন মনোয়ারা হক আতাইকুলা বদ্ধভূমিতে স্মৃতিচারণ আনুষ্ঠানে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। এরপর ২৫ এপ্রিল ১৯৯৮ এম.পি শাহিন মনোয়ারা হক ২৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্মৃতি স্তম্ভের ফলক উন্মোচন করেন।

২০১৯ সালে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সমমান মর্যাদা দেওয়া হয়।[২]

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদারি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে এবং হিন্দুদের উপর গণহত্যা শুরু করে। হাজার হাজার হিন্দু ভারত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।[৩]

ঘটনাবলী সম্পাদনা

রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর তীরে মিরাট ইউনিয়নের অন্তর্গত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালে ২৫ এপ্রিল ২০০ পাকিস্তানি সেনা সকাল ৯টায় গ্রামের পূর্বদিকে কুজাইল বাজারে অবস্থান নেয়। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের পতাকা হাতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে নদী পার হয়ে আতাইকুলা গ্রাম ঘিরে ফেলে। পালপাড়া গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চলে। অবস্থা বেগতিক দেখে গ্রামের লোক বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে যে যার মতো পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় রাজাকার আলবদররা তাদেরকে বাধা দেয়।[৪] এরপর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নীসংযোগ, লুটপাটসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেশ পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে পাকিস্তানি সেনা নির্যাতন শুরু করে।[৫] সেদিন ওই গ্রামে সারাদিন ধরে ঘরে ঘরে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে দিনের শেষ বিকালে বৈঠকখানার আঙিনায় ৮০ ব্যক্তির উপর ব্রাশফায়ার করা হয়। ঘটনাস্থলেই ৫২জন মারা যায়।[৬] ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ৮০ জনের মধ্যে ২৮ জন, তাঁদের মধ্যে ভবেশ্বর পাল একজন। ওই ঘটনার পরে ২৬ এপ্রিল ভবেশ্বর পাল আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় যোগেন্দ্রপালের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি গর্ত খুঁড়ে ওই ৫২ জন শহীদকে গণকবর দেন।[৭]

১৯৭১ সালের জুন মাসে পাক হানাদার বাহিনী আতাইকুলা গ্রামে দ্বিতীয় বার হামলা চালিয়ে নারী নির্যাতন, লুটপাট করে সেখানেই ১৪ জনকে হত্যা করে। এই ঘটনার দু সপ্তাহ পরে আতাইকুলা গ্রামে হানাদাররা তৃতীয় দফায় হামলা চালায়। এ সময় গ্রামে কোন লোকজন না থাকায় তারা ফিরে যায়।

প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল আতাইকুলা গণহত্যা দিবস হিসাবে স্মরণ করা হয়। পারিবারিক ও মুক্তিযোদ্ধারা মিলে সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদের স্মৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, গীতাপাঠ ও প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।[২]

মৃত ৫২ জনের নাম সম্পাদনা

  • যোগেন্দ্র পাল
  • সতীশ চন্দ্র পাল
  • সুরেশ্বর পাল
  • লস্কর পাল
  • বলরাম পাল
  • শ্রী দাস পাল
  • গোবিন্দ চরন পাল
  • সুশান্ত কুমার পাল
  • প্রশান্ত কুমার পাল
  • বিদ্যুৎ কুমার পাল
  • বীরেন্দ্র নাথ পাল
  • সুধীর চন্দ্র পাল
  • উত্তম কুমার পাল
  • শঙ্কর পাল
  • প্রফুল্ল কুমার পাল
  • প্রমথ নাথ পাল
  • বীরেন্দ্র সাথ পাল
  • নারায়ণ চন্দ্র পাল
  • শচীন্দ্র নাথ পাল
  • রসিক চরন পাল
  • শশী চরন পাল
  • মোহন কুমার পাল
  • সুধীর চন্দ্র পাল
  • সুনীল চন্দ্র পাল
  • যোগেন্দ্র নাথ পাল
  • বাদল নাথ পাল
  • ভাদু চরন পাল
  • সুধীর চন্দ্র পাল
  • নিবারন চন্দ্র পাল
  • তাল পাল
  • নারায়ণ চন্দ্র পাল
  • বিশু চরন পাল
  • দানু পাল
  • নরেন্দ্র নাথ পাল
  • নিখিল কুমার পাল
  • সিঙ্গেশ্বর সূত্রধর
  • সোমেশ্বর সূত্রধর
  • শিবেশ্বর সূত্রধর
  • বিক্ষয় সূত্রধর
  • রাম চন্দ্র সূত্রধর
  • চৈতন্য সূত্রধর
  • সুকমল সাহা
  • ধরেন্দ্র নাথ সরকার
  • মংলা সরকার
  • সচীন্দ্র নাথ সরকার
  • সুধীর সরকার
  • রশিক হালদার
  • বীরেশ্বর হালদার
  • রঘুবীর মাঝি
  • ফিরিঙ্গিঁ
  • প্রেম চরন পাল
  • রাজেন্দ্র নাথ পাল

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "রাণীনগরের আতাইকুলা গণহত্যা দিবস আজ"web.archive.org। ২০২০-১১-০৬। Archived from the original on ২০২০-১১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬ 
  2. "অবশেষে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেলেন নওগাঁর আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা"web.archive.org। ২০২০-১১-০৬। Archived from the original on ২০২০-১১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬ 
  3. শর্মিলা বোস Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971: Military Action: Operation Searchlight ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ মার্চ ২০০৭ তারিখে Economic and Political Weekly বিশেষ নিবন্ধ, অক্টোবর ৮, ২০০৫
  4. "SNN24.com"web.archive.org। ২০২০-১১-০৬। Archived from the original on ২০২০-১১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬ 
  5. "দৈনিক জনকন্ঠ || নওগাঁয় আতাইকুলা গণহত্যা দিবস আজ"web.archive.org। ২০২০-১১-০৬। Archived from the original on ২০২০-১১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬ 
  6. "নওগাঁর রাণীনগর ১০ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত দিবস"সময়নিউজ২৪.কম (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-১২-০৯। ২০২০-০১-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬ 
  7. "মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ ও নাটোরের গণহত্যা, বধ্যভূমি | প্রথম আলো"web.archive.org। ২০২০-১১-০৬। Archived from the original on ২০২০-১১-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-০৬