অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী

অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী (পরবর্তীতে স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী) (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ — ১৩ আগস্ট ১৯৬৮) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কর্মী , মানভূম এলাকায় সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বিপ্লবী কাজের সঙ্গে সমাজসেবা, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ ছিলেন তিনি। [১]

অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী
জন্ম
অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী

(১৯০৪-০২-১৬)১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪
রামচন্দ্রপুর পুরুলিয়া বৃটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ)
মৃত্যু১৩ আগস্ট ১৯৬৮(1968-08-13) (বয়স ৬৪)
জাতীয়তাভারতীয়
পরিচিতির কারণভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিপ্লবী
সন্তাননন্দলাল চক্রবর্তী
পিতা-মাতাযুগলকিশোর চক্রবর্তী (পিতা)

জীবনী সম্পাদনা

অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি ( ৩রা ফাল্গুন ১৩১০ বঙ্গাব্দ) বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার রামকৃষ্ণপুরে। পিতার নাম যুগলকিশোর চক্রবর্তী। অন্নদাপ্রসাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের বাসিন্দা। তারা পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজ পরিবারের কূলপুরোহিত হয়ে আসেন এবং রাজ পরিবারের দাক্ষিণ্যে রামচন্দ্রপুরের জমিদারি প্রাপ্ত হন। কিন্তু তারা ভালবাসতেন সামাজিক কাজকর্ম ও দুঃস্থদের সেবাকার্য। বাল্যকালেই অন্নদাপ্রসাদের অন্তরে বিপ্লবী চেতনার প্রকাশ পায়। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। [২] ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জের 'দরবার উৎসবে' বিদ্যালয়ে জয় জয়তু পঞ্চম জর্জ জয় হে ভারত ভূপতি গান গাইতে অস্বীকার করেন। শাস্তি পেয়েও তীব্র ধিক্কার জানিয়ে লেখেন কবিতা-

"যারা তাঁতীর কাটলো আঙুল তাদের দেব জয়

জীবন থাকতে নয়।

কিসের তাদের গানের আসর রাস্তা সাজা,

কিসের তোদের সাজগোজ আর বাজনা বাজা

কিসের তাদের হৈ চৈ এই সারা গেরামময়?

পঞ্চম জর্জ রাজা? তাতে মোদের দেশের কি?

আমার দেশের রাজা? বলিস্ না ছি ছি।

আমার দেশের রাজা হবে আমার দেশের লোক

আজকে আমোদ স্ফূর্তি সে নয়, আজকে করব শোক,

মা বলেছে আমাদের দেশের বন্ধু ওরা নয়

প্রাণ থাকতে গাইবো নাকো আমি তাদের জয়।

[৩]

বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনা

তারপর তার বয়স যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি মানভূম থেকে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত করেন তাঁর বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপ আর সেই সঙ্গে দুঃস্থদের সেবা ও সমাজসেবা। নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞান দিতে নৈশ বিদ্যালয় আর নারীশিক্ষার প্রসারে খুললেন মহিলা স্কুল। [২]

পরবর্তীতে তিনি আদিবাসী সাঁওতালদের সংঘবদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণপুরে গড়ে তোলেন বিপ্লবীদের গোপন সংস্থা আর্য আশ্রম[৩] ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রামচন্দ্রপুরে এক রাজনৈতিক কর্মিসভার আয়োজন করেন তিনি। সুভাষচন্দ্র বসুর নির্দেশে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হন অন্নদাপ্রসাদ। দুদিনের ওই কর্মিসভায় বাংলার স্বদেশিরা যোগ দেন সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। সভায় জন্ম নেয় মানভূম কর্মী সংসদ নামের এক নতুন সংগঠন। সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র বসু এবং সম্পাদক হন অন্নদাপ্রসাদ। অন্নদাপ্রসাদের ব্যবস্থাপনায় সভার আয়োজন, বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীদের যোগদান, সভায় সুভাষের উপস্থিতি ব্রিটিশ শাসককে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল। তার ওপর তরুণশক্তি নামের পত্রিকা সম্পাদনা করায় বৃটিশ শাসক তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে কারারুদ্ধ রাখে তাকে। দেড় বৎসর পর কারামুক্ত হলে দ্বিগুণ উৎসাহে দেশ ও দশের কাজে লিপ্ত হন। সংগঠিত করলেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের আইন অমান্য আন্দোলন। তার উপর ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণ ক্রমশ নির্মম হতে থাকে। তার স্বদেশি বইপত্র পুড়িয়ে দেয়, মাটিতে ফেলে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেয়। এতে রাজি না হওয়ায় গাছের সাথে বেঁধে বেদম প্রহার করা হয়। যন্ত্রণায় জ্ঞান হারান তিনি। এর ওপর তাকে ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ির পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে বহু দূর নিয়ে গিয়ে তার শরীরটাকে পুকুরে ফেলে দেয়। শেষে অনুগামী এবং পাশ্ববর্তী গ্রামবাসীদের পরিচর্যায় এবং হাজারিবাগের এক কলেজের অধ্যাপক শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের সহায়তায় তিনি চিকিৎসা পান এবং সুস্থ হন। ব্রিটিশের এই অত্যাচারে সুভাষ জোরদার আন্দোলনের ডাক দেন এবং তাঁর সেই ডাকে মানভূম এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। জনজাতির মানুষজন লাগাতার বিক্ষোভে সামিল হন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এক শীতের রাতে সুভাষচন্দ্র বসু অন্নদাপ্রসাদের সঙ্গে মোটরগাড়িতে কলকাতার উদ্দেশ্যে আদ্রা রেলস্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে এক দৃষ্টিহীন দরিদ্র মানুষ গাড়ির সামনে এসে পড়েন। সুভাষচন্দ্র তাকে দরিদ্র নিপীড়িত মানুষজনের জন্য এক দাতব্য চক্ষু হাসপাতাল গড়তে অনুরোধ করেছিলেন। [২]

সন্ন্যাস গ্রহণ সম্পাদনা

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণের পর অন্নদাপ্রসাদ 'মন্দির' কাব্যের কবি ও কাশীর শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ মঠের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী কিরণচাঁদ দরবেশের কাছে দীক্ষা নেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মগুরুর নির্দেশে নেন সন্ন্যাস এবং তার নতুন নাম হয় স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী।

সমাজসেবা সম্পাদনা

রামচন্দ্রপুরের আশ্রমে তিনি আধ্যাত্ম সাধনার পাশাপাশি স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিপ্লবী দলে গুপ্ত ঘাঁটির সঙ্গে সমাজসেবার বিভিন্ন কাজ সমানভাবে চালিয়ে গেছেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরে ও নানা দুর্যোগে পীড়িত মানুষের সেবা করেছেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কূলগুরু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামে শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ রিলিফ সোসাইটি গঠন করেছিলেন। এরই মাধ্যমে তিনি প্রথমদিকে দরিদ্র চক্ষুরোগী ও দৃষ্টিহীনদের চিকিৎসা শুরু করেন। পরে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জানুয়ারি রামচন্দ্রপুরে দুঃস্থ চক্ষুরোগীদের জন্য খুললেন নেতাজী আই হসপিটাল এবং মোটামুটি একক প্রচেষ্টায় হাসপাতালটির উন্নয়ন করেছেন।

জীবনাবসান সম্পাদনা

অন্নদাপ্রসাদ তথা বিপ্লবী সন্ন্যাসী স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট ৬৪ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৫৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "ছোট্ট ছেলের জেদ, সাহেবদের গুণ গাইবে না"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-০৬ 
  3. "মানভূম জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-০৭