স্থানের মেট্রিক সম্প্রসারণ

মহাবিশ্ব নিরন্তর সম্প্রসারিত হচ্ছে

স্থানের মেট্রিক সম্প্রসারণ (ইংরেজি ভাষায়: Metric expansion of space) বলতে মহাবিশ্বের যেকোন দুটি দূরবর্তী বস্তুর দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলাকে বোঝায়। এটি এক ধরনের অন্তর্নিহিত সম্প্রসারণ, মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে পূর্ব থেকে বিরাজমান স্থানে প্রবেশ করছে ব্যাপারটা এমন নয়, বরং বিভিন্ন অংশের দূরত্ব বাড়ছে তথা স্বয়ং স্থানেরই সম্প্রসারণ ঘটছে। মহাবিশ্ব প্রসারণের মাধ্যমে তার বাইরে অবস্থিত কোন কিছুর মধ্যে প্রবেশ করছে না। বহুল ব্যবহৃত একটি স্থূল উদাহরণ হচ্ছে বেলুন ফোলানো। একটি বেলুনের গায়ে অনেকগুলো দাগ দিয়ে বেলুনটি ফোলানো শুরু করলে দাগগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এখানে ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বকে বেলুনের দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, তাহলে বেলুনের পৃষ্ঠটিই হচ্ছে স্থান যা ফোলানোর কারণে অবিরত প্রসারিত হচ্ছে। আর বেলুনগাত্রে যে দাগগুলো রয়েছে সেগুলোকে কল্পনা করা যেতে পারে একেকটি ছায়াপথ হিসেবে, স্থানের সম্প্রসারণের কারণে ছায়াপথগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর কারণ ছায়াপথগুলোর নিজস্ব কোন বেগ নয় বরং স্থানের সম্প্রসারণের কারণে তাদের মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার হার।

মেট্রিক সম্প্রসারণ মহা বিস্ফোরণ বিশ্বতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যাকে ফ্রিদমান-ল্যমেত্র্‌-রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিক (FLRW বা ফলরও মেট্রিক) এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। মেট্রিক এমন একটি অপেক্ষক যা একটি সেটের উপাদানগুলোর পারস্পরিক দূরত্বকে প্রকাশ করতে পারে। সেদিক থেকে "মেট্রিক সম্প্রসারণ" শব্দ দুটির মাঝেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রকৃত অর্থ নিহিত আছে। তবে ফলরও মেট্রিক কেবলমাত্র মহাবিশ্বের অনেক বড় স্কেলে প্রযোজ্য। কারণ এই মেট্রিকের প্রাথমিক একটি অনুমিতি হচ্ছে মহাবিশ্ব সমসত্ত্ব এবং সমরূপ। কিন্তু আমাদের আশাপাশে তাকালে স্পষ্টতই দেখতে পাই মহাবিশ্ব সমসত্ত্ব ও সমরূপ নয়, পৃথিবীর পৃষ্ঠের চেয়ে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব অনেক কম, তারাদের তুলনায় তাদের মধ্যবর্তী স্থানের ঘনত্ব অনেক কম, আবার একেক দিকে তাকালে মহাবিশ্বের একেক রূপ চোখে পড়ে। কিন্তু অনেক বড় স্কেলে গেলে, অর্থাৎ অনেকগুলো ছায়াপথের সমষ্টিকে একটি একক হিসেবে বিবেচনা করলে মহাবিশ্ব আসলেই প্রায় সমসত্ত্ব ও সমরূপ, অর্থাৎ এই বিশ্বের এক দিকের মহা ছায়াপথ স্তবকগুলোর সাথে অন্য দিকের মহা ছায়াপথ স্তবকগুলোর তেমন কোন পার্থক্য নেই। এজন্যই ফলরও মেট্রিক কেবল মহা ছায়াপথ স্তবকদের স্কেলে প্রযোজ্য। এর থেকে ছোট স্কেলে এমনকি দুটি অংশের মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ার পরিবর্তে কমতে পারে। যেমন আকাশগঙ্গা এবং ধ্রুবমাতা ছায়াপথ দুটোর দূরত্ব দিনদিন কমছে। কিন্তু এর কারণ, তারা এত কাছাকাছি অবস্থিত যে প্রসারণমুখী বলের তুলনায় তাদের পারস্পরিক মহাকর্ষ বল বেশি শক্তিশালী। এটি ফলরও মেট্রিকের কোন সীমাবদ্ধতা নয়।

বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে কোন বস্তুর সাপেক্ষে অন্য কোন বস্তুর বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। কিন্তু স্বয়ং স্থানের ক্ষেত্রে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। স্থানের প্রসারণের বেগ আলোর চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই অনেক দূরে অবস্থিত দুটি বস্তু তাদের স্থানের সম্প্রসারণের কারণে একে অপরের থেকে আলোর চেয়েও বেশি বেগে সরে যেতে পারে। আমাদের থেকে কোন বস্তুর দূরত্ব যত বেশি তার পশ্চাদপসরণের বেগও তত বেশি, তাই একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পর বস্তুর বেগ আলোর চেয়ে বেশি হবে এবং আমরা সেটি দেখতে পারব না। যে দূরত্ব পর্যন্ত বস্তুগুলো আলোর চেয়ে কম বেগে অপসৃত হয় সেটুকু দূরত্বকে তাই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব বলা হয়। মহাবিশ্বের প্রকৃত আকার এই পর্যবেক্ষণযোগ্য আয়তনের চেয়ে অনেক বেশিও হতে পারে। অন্যদিকে আলোর সসীম বেগের কারণে অনেক দূরের বস্তু দেখার অর্থ দাঁড়ায় আসলে বস্তুটির অতীত অবস্থাকে দেখা। যেমন, ১০ আলোকবর্ষ দূরের একটি তারা থেকে আলো আমাদের কাছে আসতে ১০ বছর সময় নেয়, তাই তারাটি দেখার অর্থ দাঁড়ায় তার ১০ বছর আগের অবস্থা দেখা। এমনকি মহা বিস্ফোরণের কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত কোন ঘটনা হয়ত দূরের কোন পর্যবেক্ষকের কাছে এই মাত্র পৌঁছাবে। যেমন আমরা মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ পর্যবেক্ষ করি যা মহা বিস্ফোরণের মাত্র ৩ লক্ষ বছর পর নিসৃত হয়েছিল। তবে মেট্রিক সম্প্রসারণ নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়ে গেছে।[১][২][৩][৪][৫]

সম্প্রসারণের কারণ সম্পাদনা

স্থানের এই সম্প্রসারণের কারণ দুটি। প্রথমত, মহা বিস্ফোরণ ঘটেছিল প্রকৃতপক্ষে স্থানকালের। আমাদের চোখে দেখা বিস্ফোরণের সাথে এই বিস্ফোরণের অনেক পার্থক্য রয়েছে, তবে স্বাভাবিক বিস্ফোরণের ফলাফল দিয়ে স্থানের বিস্ফোরণের ফলাফল বোঝা সম্ভব। একটি বোমা বিস্ফোরণের পর বোমার ভেতর থাকা সবকিছু চারদিকে ছিটকে পড়ে। স্থানকালের মহা বিস্ফোরণের পরও তেমনিভাবে স্থান ছিটকে পড়ছে বা প্রসারিত হচ্ছে। এর কারণ স্বভাবতই জড়তা, নিউটনের গতি সূত্র মতে একটি গতিশীল বস্তুর উপর বাহ্যিক কোন বল প্রয়োগ করা না হলে সে আজীবন সমবেগে চলতে থাকবে। স্থানও তেমনি সমবেগে প্রসারিত হতে থাকার কথা, যদি বাহ্যিক কোন বল ক্রিয়া না করে। কিন্তু আসলে বাহ্যিক দুটি বলের প্রভাব রয়েছে। একটি মহাকর্ষ বল যা অবশ্যই আকর্ষণমুখী অর্থাৎ এই বলের কারণে এক বস্তু অপর বস্তুকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণের কারণে প্রসারণ বেগ দিন দিন কমতে থাকার কথা, তথা মহাবিশ্বের মন্দন ঘটার কথা। কিন্তু ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞানীরা এর ঠিক উল্টোটিই সত্যি বলে জানতে পারেন, মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ দিন দিন বাড়ছে অর্থাৎ তার ত্বরণ ঘটছে। এর কারণ হিসেবে বর্তমানে দায়ী করা হচ্ছে তমোশক্তি (dark energy) নামে নামে একটি শক্তির। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো যায় যে, মহাবিশ্বের তিনটি উপাদান, বিকিরণ, পদার্থ এবং তমোশক্তির ঘনত্বের উপর প্রসারণের ত্বরণ বা মন্দন নির্ভর করে। সমীকরণের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করতে হলে স্কেল গুণাঙ্ক a এর সাথে পরিচিত হবে। সাধারণভাবে বলা যায় a সময়ের একটি অপেক্ষক, সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটলে a-এর মানও বাড়বে, এই মানকে মহাবিশ্বের আকারের প্রতিনিধি হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

 
একটি সমতল (বক্রতা রাশি, k=0) মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদানের ঘনত্বের বিবর্তন স্কেল গুণাঙ্কের সাপেক্ষে দেখানো হয়েছে।
যদি বিকিরণের ঘনত্ব তিনটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় তাহলে,  
যদি পদার্থের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি হয় তাহলে,  
যদি তমোশক্তির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি হয় তাহলে,  

দেখা যাচ্ছে তমোশক্তির ঘনত্ব বেশি হলে মহাবিশ্বের সূচকীয় সম্প্রসারণ ঘটে, অর্থাৎ বেগ দিনদিন বাড়তে থাকে বা ত্বরণ ঘটে। বর্তমানে ঠিক এটিই ঘটছে। কেন এমনটি ঘটেছে তা বোঝাও খুব কঠিন নয়। তিনটি উপাদানের ঘনত্ব সময়ের সাথে কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা বুঝতে পারলেই এর কারণ বের করা সম্ভব:

বিকিরণের ঘনত্ব,  
পদার্থের ঘনত্ব,  
তমোশক্তির ঘনত্ব,  

যানের ছবিতে তিনটি ঘনত্বের এই স্কেল নির্ভরতা দেখানো হয়েছে। স্কেল গুণাঙ্কের মান যখন 'ক' তখন বিকিরণ এবং পদার্থের ঘনত্ব সমান ('চ')। কিন্তু উপরের সমীকরণ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিকিরণের ঘনত্ব পদার্থের তুলনায় দ্রুত কমে। সুতরাং বিকিরণের ঘনত্ব পদার্থের পূর্বেই তমোশক্তির ঘনত্বের নিচে নেমে যাবে (যখন স্কেল গুণাঙ্কের মান 'খ')। খ বিন্দুর পর কেবল পদার্থের ঘনত্বই তমোশক্তির চেয়ে বেশি যাবে, সুতরাং মহাকর্ষের কারণে মহাবিশ্বের মন্দন ঘটবে। কিন্তু স্কেল গুণাঙ্কের মান যখন 'গ' তখন পদার্থের ও তমোশক্তির ঘনত্ব সমান। বর্তমানে আমরা গ বিন্দুর বামে অবস্থান করছি, অর্থাৎ তমোশক্তির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তমোশক্তির ঘনত্ব কখনোই পরিবর্তিত হয় না, এটি ধ্রুবক (যার মান 'ছ')। প্রথম তিনটি সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, তমোশক্তির ঘনত্ব যখন সবচেয়ে বেশি তখন স্কেল গুণাঙ্ক সময়ের সাথে সূচকীয় হারে বৃদ্ধি পায়, যার অর্থ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের বেগ বৃদ্ধি পায় বা তার ত্বরণ ঘটে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Tamara M. Davis and Charles H. Lineweaver, Expanding Confusion: common misconceptions of cosmological horizons and the superluminal expansion of the Universe. astro-ph/0310808
  2. Alan B. Whiting (২০০৪)। "The Expansion of Space: Free Particle Motion and the Cosmological Redshift"ArXiv preprintarXiv:astro-ph/0404095 বিবকোড:2004Obs...124..174W 
  3. EF Bunn & DW Hogg (২০০৮)। "The kinematic origin of the cosmological redshift"। ArXiv preprintarXiv:0808.1081 ডিওআই:10.1119/1.3129103বিবকোড:2009AmJPh..77..688B 
  4. Yu. V. Baryshev (২০০৮)। "Expanding Space: The Root of Conceptual Problems of the Cosmological Physics"। Practical Cosmology2: 20–30। arXiv:0810.0153 বিবকোড:2008pc2..conf...20B 
  5. JA Peacock (২০০৮)। "A diatribe on expanding space"ArXiv preprintarXiv:0809.4573 বিবকোড:2008arXiv0809.4573P