সত্রপ

প্রাচীন পারস্যের প্রদেশসমূহের শাসক
(সাত্রাপ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

সত্রপ বা ক্ষত্রপ (প্রাচীন পারসিক ভাষায় xšaçapāvān, উচ্চারণ ক্ষত্রপওন, অর্থাৎ প্রদেশরক্ষক) বলতে প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক গভর্নরকে বোঝানো হত।[১] প্রাচীন পারস্যের একেকটি বড় প্রদেশের প্রধান হিসেবে তাদের প্রশাসনিক প্রধান ও সামরিক নেতৃত্ব উভয় দায়িত্বই পালন করতে হত। প্রাচীন মিডিয় (মোটামুটি ৬৭৮ - ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও হাখমানেশি সাম্রাজ্যের (৫৫০ - ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময়েই এই প্রশাসনিক ও সামরিক পদটির উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীকালে ব্যাকট্রিয় গ্রিক (২৪৫ - ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), পার্থিয় (২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ২২৪ খ্রিষ্টাব্দ) ও সাসানিদদের (২২৪ - ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনকালেও পদটি বজায় ছিল। কিন্তু আরবদের পারস্যবিজয় তথা ইসলামের আগমণের পর (মধ্য ৭ম শতাব্দী) পদটি অবলুপ্ত হয়।

হাখমানেশি সাম্রাজ্যের কিছু সত্রপ

ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

সত্রপ শব্দটি প্রাচীন পারসিক শব্দ ক্ষত্রপওন'এর গ্রিক রূপ। ঐ একই শব্দ সংস্কৃতে ক্ষত্রপ বা ক্ষত্রপম হিসেবে উচ্চারিত হত। শব্দটি বাস্তবে xšaça (প্রদেশ বা অঞ্চল) ও pāvan (রক্ষক) শব্দদুটির সন্ধিবদ্ধ রূপ। পারসিক সভ্যতার সাথে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার সুপ্রাচীন যোগাযোগের ভিত্তিতে শব্দটি গ্রিক ভাষায় প্রথমে σατράπης (সত্রপেস) রূপে প্রবেশ করে ও পরে লাতিন ভাষাতেও একই রূপে গৃহীত হয়। বর্তমান পার্শি ভাষায় শব্দটির রূপ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে شهربان (শহরবান); কিন্তু সাথে সাথে এর অর্থেরও পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে এর মানে শহরের রক্ষক বা শহর-প্রধান।

ইতিহাস সম্পাদনা

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে মিডিয় সাম্রাজ্যের আমলেই সমগ্র সাম্রাজ্যকে কতগুলি প্রদেশ বা অঞ্চলে ভাগ করার ধারণাটির উদ্ভব ঘটে। তখন থেকেই সত্রপি বা প্রদেশগুলির উৎপত্তি শুরু হয়।[২] অন্তত ৬৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই এর শুরু বলে জানতে পারা গেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া হাখমানেশি সম্রাট মহান কুরুশের আমলে [খ্রিস্টপূর্ব ৫৭৬ (সম্ভবত) - ৫৩০][৩] ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হতে শুরু করে।[৪] বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে বুক অব দানিয়েলের ৬ পরিচ্ছদের প্রথম কবিতা থেকেও আমরা মিডিয় সাম্রাজ্যে সত্রপদের অস্তিত্বর কথা জানতে পারি। সেখানে মহান কুরুশের নিযুক্ত শতাধিক সত্রপের উল্লেখও পাওয়া যায়। যাইহোক, কুরুশের আমলে সত্রপ পদটির ধারণাগত কিছু বিবর্তন ঘটে। এর আগে পর্যন্ত প্রদেশগুলিতে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত শাসকরা বাস্তবে ছিল প্রায় স্বাধীন রাজা। কিন্তু হাখমানেশি আমলে যে নতুন পারসিক ঐতিহ্যর জন্ম হয়, তা অনুযায়ী 'রাজা' পদটির একটি দৈব অনুমোদন রয়েছে বলে মনে করা হত। ফলে এই সময় থেকে প্রদেশগুলির শাসকনিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে শুধুমাত্র রাজবংশজাত সদস্যদেরই মনোনয়ন করা শুরু হয়।[৫] এই শাসকরা সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হত, পারসিক রাজপরিবারেরই সদস্য হত এবং বার্ষিক একটি নির্দিষ্ট করের বিনিময়ে সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকত। অর্থাৎ কোনও অর্থেই তারা রাজা ছিল না, বরং প্রদেশে রাজ-প্রতিনিধিরূপে তারা সর্বোচ্চ পদটি অলংকৃত করতো। সম্রাট প্রথম দারিয়ুসের আমলে (৫২২ - ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সমগ্র সাম্রাজ্যকে কতগুলি প্রদেশে ভাগ করে শাসনের এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা নির্দিষ্টরূপ ধারণ করে। এই সময় পারস্য সাম্রাজ্যকে যতদূর সম্ভব মোট ২০টি সত্রপিতে ভাগ করা হয়েছিল।[৫] গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকেই আমরা এই ২০টি সত্রপির কথা জানতে পারি।[৬] কিন্তু দারিয়ুসের কবরস্থানে প্রাপ্ত লিপিতে ২৯টি সত্রপির কথা পাওয়া গেছে। আবার সম্রাট প্রথম দারিয়ুসের সমকালীন ইরানের বেহিস্তান শিলালিপিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দারিয়ুস তার রাজত্বকালে সত্রপির সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২৩'এ দাঁড় করান। এই সময়ের একাধিক শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সত্রপিগুলির তালিকা তুলনা করে দেখা যায় তাদের সংখ্যা ছিল এইসময় ১২ থেকে ৩১।[৭] এই তালিকাগুলি প্রায় প্রত্যেকটিই শুরু হয়েছে নিম্নলিখিতভাবে[৭] -

সম্রাট দারিয়ুস বলেন, এইসব রাজ্যসমূহ আমার অধীন। আহুরা মাজদার প্রদত্ত অধিকারবলে আমি (তাদের) রাজা। (Es spricht Dareios, der König: Dies sind die Länder, die mir zugefallen sind. Durch die Gunst des Ahura Mazda war ich [ihr] König.)

সমকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সত্রপির সংখ্যার এই বিভিন্নতা থেকে বোঝা যায়, পারসিক সাম্রাজ্যের এই প্রথম দিকে, অন্তত প্রথম দারিয়ুসের সময় পর্যন্ত সমগ্র সাম্রাজ্যকে এইভাবে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করার প্রক্রিয়াটি চালু হলেও প্রদেশগুলির সংখ্যা ও সীমারেখা তখনও সুস্থিতি অর্জন করেনি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Satrap - Definition and More from the Free Merriam-Webster Dictionary"। Merriam-webster.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০১-২৬ 
  2. Satraps and satrapies. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে livius.org. সংগৃহীত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৫।
  3. Dandamaev, M. A.. A political history of the Achaemenid empire. Leiden: Brill, 1989. আইএসবিএন ৯০-০৪-০৯১৭২-৬. পৃঃ ৩৭৩।
  4. Dandamaev, M. A.. A political history of the Achaemenid empire. Leiden: Brill, 1989. আইএসবিএন ৯০-০৪-০৯১৭২-৬. পৃঃ ৪২।
  5. "Satrap". Encyclopaedia Britannica. সংগৃহীত ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫।
  6. Klinkott, Hilmar. Der Satrap: ein achaimenidischer Amtsträger und seine Handlungsspielräume. Frankfurt am Main: Verlag Antike, 2005. আইএসবিএন ৩-৯৩৮০৩২-০২-২
  7. Klinkott, Hilmar. Der Satrap: ein achaimenidischer Amtsträger und seine Handlungsspielräume. Frankfurt am Main: Verlag Antike, 2005. আইএসবিএন ৩-৯৩৮০৩২-০২-২ পৃঃ ৬৭।

আরোও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা