মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুম

মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুম (লাতিন ভাষায়: Mysterium Cosmographicum, অর্থ: মহাবিশ্বের পবিত্র রহস্য) জার্মান জ্যোতির্বিদ ইয়োহানেস কেপলারের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ। এটি ছিল কোপের্নিকুসের বিশ্ব ব্যবস্থা প্রমাণের জন্য প্রকাশিত প্রথম বই। ১৬২১ সালে নিজের গবেষণা জীবন সম্পর্খে মন্তব্য করতে গিয়ে কেপলার তার মুস্তেরিয়ুম সম্পর্কে বলেছিলেন,

প্লেটোনীয় ঘনবস্তুর মাধ্যমে সৌরজগতের যে মডেল তৈরি করেছিলেন কেপলার। তার মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুম (১৬০০) বইয়ে।

রচনা এবং প্রকাশের ইতিবৃত্ত সম্পাদনা

কেপলারের দাবী অনুসারে ১৫৯৫ সালের ১৯শে জানুয়ারি গ্রাৎসের একটি শ্রেণীকক্ষে রাশিচক্রে শনিবৃহস্পতি গ্রহের পর্যাবৃত্ত সংযোগ পড়ানোর সময় তার মনে এক স্বর্গীয় চিন্তা খেলে যায়; তিনি বুঝতে পারেন সুষম বহুভুজের অন্তর্বৃত্ত এবং পরিবৃত্ত যেমন বহুভুজটির সাথে সর্বদা একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে আবদ্ধ হয়, মহাবিশ্বের জ্যামিতিক ভিত্তিও সম্ভবত তেমন। এরপর অনেক ধরনের পরীক্ষা করেন, কিন্তু অতিরিক্ত গ্রহ যোগ করেও শেষ পর্যন্ত সুষম বহুভুজদের এমন কোন সমাবেশ পাননি যা তখন পর্যন্ত জানা জ্যোতিষ্কগুলোর গতিপথ ব্যাখ্যা করতে পারে। অগত্যা ত্রিমাত্রিক বহুতলক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে আবিষ্কার করেন যে, পাঁচটি প্লেটোনীয় ঘনবস্তুকে খ-গোলকের মাধ্যমে অন্তর্লিখিত এবং পরিলিখিত করা যায়। এর মাধ্যমেই মুস্তেরিয়ুমের মূলভাব তৈরি হয়।

বইয়ের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় কেপলার ভেবেছিলেন তিনি মহাবিশ্বের জ্যামিতি নিয়ে ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনা বুঝে ফেলেছেন। কোপের্নিকুসের বিশ্ব-ব্যবস্থা নিয়ে তার এত আগ্রহের কারণ ছিল মূলত আধ্যাত্মিক বা ধর্মতাত্ত্বিক, তিনি ভৌত বিশ্বের সাথে আধ্যাত্মিক জগতের সম্বন্ধ খুঁজে পেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি ভাবতেন মহাবিশ্ব নিজেই ঈশ্বরের একটি ছবি, যেখানে সূর্য পিতা, তারাসমূহের খ-গোলক পুত্র, আর মাঝের স্থানটুকু পবিত্র আত্মা। বাইবেলে ভূকেন্দ্রিক মতবাদ সমর্থন করা হচ্ছে মনে হলেও তিনি সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের সাথে বাইবেলের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে মুস্তেরিয়ুমের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে একটি পৃথক অধ্যায়ই লিখেছিলেন।[২]

 
মডেলটির অভ্যন্তরভাগের একটি বিস্তৃত ছবি

তার পৃষ্ঠপোষক মিখায়েল মায়েস্টলিনের সমর্থন ও সাহায্যে তিনি ট্যুবিঙেন ইউনিভার্সিটি থেকে পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের অনুমতি পান, তবে শর্ত ছিল বাইবেলের চুলচেরা বিশ্লেষনসমৃদ্ধ অধ্যায়টি বাদ দিয়ে তার বদলে কোপের্নিকুসের বিশ্ব-ব্যবস্থার একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা ও তার নিজের নতুন ধারণাগুলোর সাধারণ পরিচিতি লিখতে হবে। ১৫৯৬ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, ১৫৯৭-এ তিনি নিজের কপিগুলো হাতে পান এবং বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠাতে থাকেন। খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা না পেলেও বইটি কেপলারকে একজন উঁচুমানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। তার আত্মনিবেদন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গ্রাৎসে তার পৃষ্ঠপোষকরা সন্তুষ্ট হয় এবং ভৌগলিকবাবেই তার পৃষ্ঠপোষকতা বেড়ে যায়।[৩]

পরবর্তী কাজের সুবাদে বেশ কিছু পরিবর্তন আনলেও কেপলার কখনো প্লেটোনীয় ঘনবস্তুর উপর ভিত্তি করে নির্মীত তার এই বিশ্বতাত্ত্বিক মডেলটি বর্জন করেননি। পরবর্তী জীবনে তার অনেক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কাজের উদ্দেশ্যও ছিল মডেলটিকে আরও সূক্ষ্ণ ও কার্যকরী করে তোলা, বিশেষ করে গ্রহগুলোর সঠিক উৎকেন্দ্রিকতা নির্ণয়ের মাধ্যমে খ-গোলকগুলোর অন্তর্ব্যাসার্ধ্য ও বহির্ব্যাসার্ধ্যের আরও সঠিক মান নির্ণয়ের ব্রত ছিলেন। ১৬২১ সালে তিনি মুস্তেরিয়ুমের একটি বর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। প্রথমটির প্রায় অর্ধেক পরিমাণ বেশি দীর্ঘ এবং বেশ কিছু সংশোধন ও পাদটীকার মাধ্যমে গত ২৫ বছরে তার অর্জন ও উপলব্ধিগুলো এই সংস্করণে তুলে ধরেন।[৪]

বইটির বিষয়বস্তু সম্পাদনা

বইটির মূল ভিত্তি ছিল আদিরূপ বা আর্কিটাইপের ধারণা। একজন স্থপতি যেমন প্রথমে একটি নকশা তৈরি করে তারপর ব্যবহারিক কাজে নামেন, কেপলার মনে করতেন ঈশ্বর তেমনি একটি আদিরূপ তৈরি করে সে অনুযায়ী মহাবিশ্বকে সাজিয়েছেন। পিথাগোরাস এবং প্লেটোর মতই তিনি এই আদিরূপটিকে প্রকৃতিগতভাবে গাণিতিক এবং বৈশিষ্ট্যগতভাবে নৈসর্গ্যিক মনে করতেন।

মুস্তেরিয়ুমে তিনি মহাবিশ্বের স্থির অবস্থা বিষয়ে কথা বলেন। সূর্য, স্থির তারা এবং স্থানের স্থিরতাকে তিনি পবিত্র ত্রিত্বের (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা) সাথে তুলনা করেন। ত্রিত্বের তিনটি অংশ থাকলেও ত্রিত্ব নিজে অনঢ় এবং অপরিবর্তনীয়, ঠিক তেমনি তিনি বলেন যে মহাবিশ্ব একটি গোলক হিসেবে অপরিবর্তনীয় এবং অনঢ় কিন্তু তার তিনটি অংশ রয়েছে: সূর্য পিতা তথা ঈশ্বরের মত, স্থির খ-গোলকে নিবদ্ধ তারাগুলো পুত্রের মত, আর স্থান এবং স্থান জুড়ে থাকা বায়ু হচ্ছে পবিত্র আত্মার মত।[৫]

কেপলার এই দেখান কীভাবে পাঁচটি প্লেটোনীয় ঘনবস্তুকে খ-গোলকের মাধ্যমে অন্তর্লিখিত এবং পরিলিখিত করা যায়। তিনি বস্তুগুলোর একটিকে আরেকটির ভেতর স্থাপন করে প্রতিটিকে একটি অন্তর্বৃত্ত ও একটি পরিবৃত্ত দ্বারা আবদ্ধ করেন। এক বস্তুর অন্তর্বৃত্ত তার পরেরটির পরিবৃত্তের সাথে মিলে একটি খ-গোলক গঠন করে। এভাবে পাঁচটি বস্তুর জন্য মোট ছয়টি গোলক পাওয়া যায়। তখন পর্যন্ত জানা ছয়টি গ্রহকে (বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি) কেপলার এই ছয় গোলকে স্থান করে দেন। অষ্টতলক, বিংশতলক, দ্বাদশতলক, চতুষ্তলক এবং ঘনক- এই বস্তু পাঁচটিকে গুরুত্ব অনুযায়ী সঠিক ক্রমে সাজিয়ে দেখেন, গোলকগুলোকে এমন দূরত্বে স্থাপন করা সম্ভব যাতে তা গ্রহীয় কক্ষপথের আপেক্ষিক আকারের প্রতিনিধিত্ব করে। অবশ্যই সে সময়কার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দূরত্বের যে মান পাওয়া গিয়েছিল সেটাই তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এমনকি কেপলার প্রতিটি গ্রহের খ-গোলকের সাথে তার কক্ষীয় পর্যায়কালের সম্পর্কসূচক একটি সূত্রও আবিষ্কার করে ফেলেন: ভেতর থেকে বাইরের দিকে যেতে থাকলে কক্ষীয় পর্যায়কালের বৃদ্ধি পরস্পরসংলগ্ন গ্রহ দুটির কক্ষীয় ব্যাসার্ধ্যের পার্থক্যের দ্বিগুণ। পরে অবশ্য সঠিক মান নির্ণয়ে সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তিনি এই সূত্রটি পরিত্যাগ করেছিলেন।[৬]

বহুতলকের মাধ্যমে তৈরি এই মডেলটি ব্যবহারিক ও আদর্শিক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার পর কেপলার বহুতলকের ধারণার সাথে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও সঙ্গীতের মিলন ঘটান। এর সাথে টলেমির হারমোনি সূত্রের কিছুটা মিল রয়েছে।[৫]

বইটির প্রভাব সম্পাদনা

মুস্তেরিয়ুমের প্রভাব সম্পর্কে প্রথম কথা হচ্ছে, এটি ছিল কোপের্নিকুসের তত্ত্বের আধুনিকায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ। De revolutionibus orbium coelestium গ্রন্থে কোপের্নিকুস যে একটি সৌরকেন্দ্রিক মডেল তৈরি করার চেষ্টা করেছেন সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেটি করতে গিয়ে তাকে টলেমীয় পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়েছে, গ্রহগুলোর কক্ষীয় বেগ ব্যাখ্যা করতে অণুবৃত্ত ও উৎকেন্দ্রিক বৃত্তের ধারণা তুলে ধরতে হয়েছে। উপরন্তু কোপের্নিকুস নিজেও সূর্যের কক্ষপথের কেন্দ্রের বদলে পৃথিবীর কক্ষপথের কেন্দ্রকে প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে উল্লেখ করে যাচ্ছিলেন। তার নিজের লেখাতেই এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায়, "হিসাবের সুবিধা এবং টলেমির বিশ্ব থেকে খুব বেশি সরে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করে না দেয়ার জন্য"। সেহেতু মুস্তেরিয়ুম কসমোগ্রাফিকুমের তত্ত্ব ভুল হলেও নিঃসন্দেহে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নতির পেছনে তার বিশাল ভূমিকা আছে। কারণ এই গ্রন্থই কোপের্নিকুসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ থেকে টলেমির শেষচিহ্ন বিলুপ্ত করে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Rhonda Martens, Kepler's Philosophy and the New Astronomy, Princeton University Press, ২০০০, পৃ. ৩৯
  2. Barker and Goldstein. "Theological Foundations of Kepler's Astronomy," pp.99–103, 112–113.
  3. Caspar. Kepler, pp.65–71.
  4. Field. Kepler's Geometrical Cosmology, Chapter IV, p 73ff.
  5. Rhonda Martens, Kepler's Philosophy and the New Astronomy, Princeton University Press, ২০০০, পৃ. ৪০-৪৫
  6. Caspar. Kepler, pp.60–65; see also: Barker and Goldstein, "Theological Foundations of Kepler's Astronomy."
  7. Dreyer, J.L.E. A History of Astronomy from Thales to Kepler, Dover Publications, 1953, pp.331, 377-379.