বল্গা হরিণ

হরিণের প্রজাতি

বল্গা হরিণ (ইংরেজি: Reindeer, Caribou; বৈজ্ঞানিক নাম: Rangifer tarandus) বৃহৎ আকৃতির এক ধরনের হরিণ বিশেষতুষারাবৃত ও শীতপ্রধান দেশসমূহে এ ধরনের হরিণ মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। উত্তর আমেরিকায় বল্গা হরিণ ক্যারিবো নামে পরিচিত। উত্তর গোলার্ধে এদের আবাসস্থল; ও অভিবাসিত মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে ব্যাপক সংখ্যায় সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।[১]

বল্গা হরিণ
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণী
পর্ব: মেরুদণ্ডী
শ্রেণী: স্তন্যপায়ী
বর্গ: Artiodactyla
পরিবার: Cervidae
উপপরিবার: Capreolinae
গণ: Rangifer
C.H. Smith, 1827
প্রজাতি: R. tarandus
দ্বিপদী নাম
Rangifer tarandus
(Linnaeus, 1758)
উপ-প্রজাতি

অনেক

উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয়ার অংশবিশেষে বল্গা হরিণের আবাসস্থল রয়েছে।

এর কিছু উপ-প্রজাতি অত্যন্ত দূর্লভ এবং এক বা একাধিক উপ-প্রজাতি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত।[২][৩]

অবস্থান সম্পাদনা

উত্তর হোলার্কটিক অঞ্চলের তুন্দ্রাতৈগা বনভূমির সর্বত্র অনেক প্রজাতির বল্গা হরিণ দেখা যায়।[৪] উৎপত্তিগতভাবে বল্গা হরিণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, ইউরোপের উত্তরাঞ্চল, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং চীনের উত্তরাঞ্চলে ৫০তম অক্ষাংশে দেখা গিয়েছিল।

উত্তর আমেরিকার কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা এবং ওয়াশিংটন থেকে মেইন পর্যন্ত এরা বিচরণ করতো। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত আইডাহো অঙ্গরাজ্যে দেখা যেত।[১] প্রাকৃতিকভাবে সাখালিন, গ্রীনল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডে পাওয়া যেত। প্লিস্টোসিন যুগে উত্তর আমেরিকার নেভাদার দক্ষিণে এবং টেনেসিতে ও ইউরোপের স্পেনে দেখা গেছে।[৪][৫]

বর্তমানে তাদের ঐতিহাসিক বাসস্থানগুলোর অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাংশে এর বিলুপ্তি ঘটেছে বেশি। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া, গ্রীনল্যান্ড, আলাস্কা এবং কানাডায় বুনো বল্গা হরিণের প্রাচুর্য্য রয়েছে। কুইবেকের তুন্দ্রা অঞ্চলে জর্জ নদীর অববাহিকা এবং কানাডার উত্তরাঞ্চলীয় কুইবেক প্রদেশের ল্যাব্রাডরে হরিণ পালে পালে কসবাস করে। এখানে সাংখ্যিকতার বিচারে একসময় বিশ্বের বৃহত্তম বল্গা হরিণের আবাসস্থল ছিল। আট থেক নয় লক্ষ হরিণের মধ্যে ডিসেম্বর, ২০১১ পর্যন্ত সেখানে রয়েছ চুয়াত্তর হাজার। ৯২ শতাংশ বল্গা হরিণ কমে যাবার প্রধান কারণ হলো - আকরিক লৌহ খনি, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রাস্তা, দালান-কোঠা নির্মাণ ইত্যাদি।[৬]

বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পাদনা

রঙ এবং আকারের ওপর নির্ভর করে বল্গা হরিণকে চিহ্নিত করা যায়। পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গ - উভয় ধরনের হরিণেই শাখাযুক্ত শিং রয়েছে। তবে পুরুষ বল্গা হরিণের শিং তুলনামূলকভাবে বড়। যেখানে স্ত্রী হরিণের অভাব রয়েছে সেখানে এদের সংখ্যা কমে যায়। এর লোমের বর্ণ পৃথক হতে পারে। ঋতুভেদ এবং উপ-প্রজাতির ওপর ভিত্তি করে এ পার্থক্য হয়। একমাত্র সার্ভিড প্রজাতির প্রাণী হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি স্ত্রীজাতীয় প্রাণীর মাথায়ও শিং উঠে।[৭]

সেপ্টেম্বরের শেষার্ধ থেকে নভেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত বল্গা হরিণের প্রজনন মৌসুম চলতে থাকে। পুরুষ হরিণেরা স্ত্রী হরিণদের সাথে যৌনমিলনের জন্য একে-অপরের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় ও কুপোকাত করার চেষ্টা চালায়। লড়াইয়ে বিজয়ী ও আধিপত্য বিস্তারকারী একটি ষাঁড় বল্গা হরিণ ১৫ থেকে ২০টি স্ত্রী হরিণের সাথে যৌনমিলনের সুযোগ লাভ করে। এ সময় পুরুষ হরিণটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও শরীরে সঞ্চিত শক্তি হারাতে থাকে।

পরের বছর মে অথবা জুন মাসে বল্গা হরিণ শাবক জন্মগ্রহণ করে। কম-বেশি ৪৫দিনের মধ্যে শাবকগুলো ঘাস এবং অন্যান্য খাদ্য খেতে শিখে যায়। কিন্তু স্বাধীনভাবে চলার জন্য তাদেরকে পরবর্তী বছরের শরৎকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় পর্যন্ত মায়ের দুধ চোষে খেয়ে জীবন চালাতে থাকে।

বল্গা হরিণ রোমন্থক প্রাণী, অর্থাৎ জাবর কাটে। এর চার-প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট পাকস্থলী রয়েছে। প্রধানত এরা শীতকালে শৈবালজাতীয় খাবার খায়। এছাড়াও, উইলো এবং বার্চ বৃক্ষের পাতাসহ নলখাগড়া ও ঘাস খেতে পছন্দ করে। কিছু আচরণে প্রকাশ পেয়েছেএ যে এরা মাঝে মাঝে ছোট ইঁদুরজাতীয় ল্যামিং,[৮] আর্কটিক চর মাছ ও পাখীর ডিম খেয়ে থাকে।[৯]

ধারণা করা হয় যে, একমাত্র স্তন্যপায়ী জীব হিসেবে অতিবেগুনী রশ্মিতেও বল্গা হরিণ দেখতে পায়। ২০১১ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায়, বল্গা হরিণ ৩২০ ন্যানোমিটারের চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সহ্য করতে পারে; যেখানে মানুষের সহ্য ক্ষমতা ৪০০ ন্যানোমিটার। এরফলে উত্তর মেরুতে তাদেরকে আত্মরক্ষায় সহায়তা করছে। কারণ, স্থলভাগের সমান্তরালে মিশে যাওয়া আলোর সাহায্যে মুত্র এবং লোমের ন্যায় সৃষ্ট পদার্থ অতিবেগুনী রশ্মিতেও দেখা যায়।[১০]

দৈহিক গঠন সম্পাদনা

স্ত্রীজাতীয় বল্গা হরিণের দৈর্ঘ্য সাধারণতঃ ১৬২–২০৫ সেমি (৬৪–৮১ ইঞ্চি) এবং ওজনে ৮০–১২০ কিলোগ্রাম (১৮০–২৬০ পা)[১১] পুরুষ বা ষাড়জাতীয় বল্গা হরিণ তুলনামূলকভাবে বড় হয়। অবশ্য এ পরিমাপ উপ-প্রজাতিতে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এদের দৈর্ঘ্য ১৮০–২১৪ সেমি (৭১–৮৪ ইঞ্চি) এবং ওজনে ১৫৯–১৮২ কিলোগ্রাম (৩৫১–৪০১ পা) হয়।[১১] ব্যতিক্রম হিসেবে বৃহৎ আকৃতির ষাড়জাতীয় বল্গা হরিণের ওজন ৩১৮ কিলোগ্রাম (৭০১ পা) হতে পারে।[১১]

কাঁধের দৈর্ঘ্য ৮৫ থেকে ১৫০ সেমি (৩৩ থেকে ৫৯ ইঞ্চি) এবং লেজ ১৪ থেকে ২০ সেমি (৫.৫ থেকে ৭.৯ ইঞ্চি) লম্বা হয়ে থাকে। উপ-প্রজাতি হিসেবে ভ্যালবার্ড দ্বীপের তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির R. t. platyrhynchus বল্গা হরিণ রয়েছে। স্ত্রীজাতীয় হরিণের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ সেমি (৫৯ ইঞ্চি), ওজন বসন্তকালে ৫৩ কিলোগ্রাম (১১৭ পা) এবং শরৎকালে ৭০ কিলোগ্রাম (১৫০ পা) হয়।[১২] ষাড়জাতীয় হরিণের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০ সেমি (৬৩ ইঞ্চি) এবং ওজন বসন্তকালে ৬৫ কিলোগ্রাম (১৪৩ পা) এবং শরৎকালে ৯০ কিলোগ্রাম (২০০ পা) হয়ে থাকে।[১২]

খর্বাকৃতি পায়ের গড়নের বল্গা হরিণ তুলনামূলকভাবে তাদের প্রতিপক্ষীয় বন্য বল্গা হরিণের চেয়ে ওজনে ভারী হয় ও গৃহে পালন করা যায়।

ব্যবহার সম্পাদনা

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বুনো বল্গা হরিণ শিকার করতো। আটক হরিণকে গৃহপালিত কিংবা অর্ধ-গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করার লক্ষ্যে পোষ মানানো হয়। এর কাছ থেকে মাংস, চামড়া, শিং, দুধ পাওয়া যায়। উত্তর গোলার্ধের অধিবাসীদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বল্গা হরিণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১৩]

অবস্থানগত কারণে দূরত্ব হলেও পৌরাণীকিতে এর ভূমিকা ও অবস্থান রয়েছে। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে আমেরিকায় ক্রিসমাসের বা বড়দিনের পর্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও অন্যতম প্রধান আকর্ষণ পিছনে অবস্থানরত সান্টাক্লজকে একদল বল্গা হরিণ টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়।[১৪] উত্তরাঞ্চলীয় ফেনোস্ক্যান্ডিয়ার ল্যাপল্যান্ড অঞ্চলে পুল্কা টেনে নেয়ার ক্ষেত্রে এজাতীয় হরিণের ভূমিকা ব্যাপক।[১৫]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Henttonen, H. & Tikhonov, A. (2008). Rangifer tarandus. 2008 IUCN Red List of Threatened Species. IUCN 2008. Retrieved on 29 April 2010.
  2. Peter Gravlund, Morten Meldgaard, Svante Pääbo, and Peter Arctander (১৯৯৮)। "Polyphyletic Origin of the Small-Bodied, High-Arctic Subspecies of Tundra Reindeer (Rangifer tarandus)"। Molecular Phylogenetics and Evolution10 (2): 151–9। ডিওআই:10.1006/mpev.1998.0525পিএমআইডি 9878226 
  3. S. A. Byun, B. F. Koop, and T. E. Reimchen (২০০২)। "Evolution of the Dawson caribou (Rangifer tarandus dawsoni)"Can. J. Zool.80 (5): 956–960। ডিওআই:10.1139/z02-062 
  4. Novak, R. M. (editor) (1999). Walker's Mammals of the World. Vol. 2. 6th edition. Johns Hopkins University Press, Baltimore. pp. 1128–1130. আইএসবিএন ০-৮০১৮-৫৭৮৯-৯
  5. Sommer R. S. and Nadachowski A. (২০০৬)। "Glacial refugia of mammals in Europe: evidence from fossil records"। Mammal Rev36 (4): 251–265। ডিওআই:10.1111/j.1365-2907.2006.00093.x 
  6. Christmas reindeer mystery as world’s largest herd plummets Survival 21 December
  7. New World Deer (Capriolinae). ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে Answers.com
  8. Lemmings ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ নভেম্বর ২০১১ তারিখে at Hinterland Who's Who
  9. Terrestrial Mammals of Nunavut by Ingrid Anand-Wheeler. আইএসবিএন ১-৫৫৩২৫-০৩৫-৪.
  10. Reindeer use UV light to survive in the wild. Ucl.ac.uk (2011-05-26). Retrieved on 2011-09-16.
  11. Caribou at the Alaska Department of Fish & Game. Adfg.state.ak.us. Retrieved on 2011-09-16.
  12. Aanes, R. (2007). Svalbard reindeer. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে Norwegian Polar Institute.
  13. "In North America and Eurasia the species has long been an important resource—in many areas the most important resource—for peoples inhabiting the northern boreal forest and tundra regions. Known human dependence on caribou/wild reindeer has a long history, beginning in the Middle Pleistocene (Banfield 1961:170; Kurtén 1968:170) and continuing to the present....The caribou/wild reindeer is thus an animal that has been a major resource for humans throughout a tremendous geographic area and across a time span of tens of thousands of years." Ernest S. Burch, Jr. (১৯৭২)। "The Caribou/Wild Reindeer as a Human Resource"American Antiquity37 (3): 339–368। জেস্টোর 278435ডিওআই:10.2307/278435 
  14. Flying Reindeer and Santa Claus: Fact, Fiction and Myth. Icr.arcticportal.org (2008-12-15). Retrieved on 2011-09-16.
  15. The Sámi and their reindeer – University of Texas at Austin

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

ক্যারিবো-বৈশিষ্ট্যাবলীপূর্ণ সংযোগ সম্পাদনা