নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

ফরাসি সমরনেতা, রাজনীতিবিদ ও সম্রাট (১৭৬৯-১৮২১)

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট[ক] বা নাপলেয়ঁ বনাপার্ত[খ] (ফরাসি: Napoléon Bonaparte, উচ্চারণ: [napɔleɔ̃ bɔnapaʁt]; জন্মনাম: Buonaparte}};[১]}} ১৫ই আগস্ট ১৭৬৯ – ৫ই মে ১৮২১) ছিলেন একজন ফরাসি সম্রাট ও সামরিক অধিনায়ক যিনি ফরাসি বিপ্লবের সময় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং বিপ্লবী যুদ্ধে বহু সফল সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসালও ( First Consul ) ছিলেন। তিনি ১৮ মে, ১৮০৪ থেকে ৬ই এপ্রিল, ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং পুনরায় ১৮১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত স্বল্পসময়ের জন্য ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইতালির রাজাও ছিলেন। এছাড়াও তিনি সুইস কনফেডারেশনের মধ্যস্থাকারী ও কনফেডারেশন অফ রাইনের রক্ষকও ছিলেন।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
Full length portrait of Napoleon in his forties, in high-ranking white and dark blue military dress uniform. He stands amid rich 18th century furniture laden with papers, and gazes at the viewer. His hair is Brutus style, cropped close but with a short fringe in front, and his right hand is tucked in his waistcoat.
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্ট এ সংরক্ষিত ১৮১২ সালের একটি চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মটিতে নাপোলেওঁকে তার স্টাডিতে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। চিত্রকর্মটি জ্যাকুইস-লুইস ডেভিড এঁকেছেন।
ফরাসি সম্রাট
রাজত্ব১৮ মে ১৮০৪ – ১১ এপ্রিল ১৮১৪
২০ মার্চ ১৮১৫ – ২২ জুন ১৮১৫
রাজ্যাভিষেক২ ডিসেম্বর ১৮০৪
পূর্বসূরিNone (himself as First Consul of the French First Republic; previous ruling monarch was Louis XVI)
উত্তরসূরিLouis XVIII (de jure in 1814)
ইতালীয় সম্রাট
রাজত্ব১৭ মার্চ ১৮০৫ – ১১ এপ্রিল ১৮১৪
রাজ্যাভিষেক২৬ মে ১৮০৫
পূর্বসূরিNone (himself as President of the Italian Republic; previous ruling monarch was Emperor Charles V)
উত্তরসূরিNone (kingdom disbanded, next king of Italy was Victor Emmanuel II)
জন্ম(১৭৬৯-০৮-১৫)১৫ আগস্ট ১৭৬৯
Ajaccio, Corsica, France
মৃত্যু৫ মে ১৮২১(1821-05-05) (বয়স ৫১)
Longwood, Saint Helena, British Empire
সমাধি
দাম্পত্য সঙ্গীJoséphine de Beauharnais
Marie Louise of Austria
বংশধরদ্বিতীয় নেপোলিয়ন
পূর্ণ নাম
Napoleon Bonaparte
রাজবংশHouse of Bonaparte
পিতাCarlo Buonaparte
মাতাLetizia Ramolino
ধর্মRoman Catholicism (see Napoleon and religions)
স্বাক্ষরনেপোলিয়ন বোনাপার্ট স্বাক্ষর
২৩ বছরের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কর্সিকান রিপাবলিকান স্বেচ্ছাসেবকদের একটি ব্যাটালিয়নের লেফটেন্যান্ট কর্নেল

তার নেতৃত্বে ফরাসি সেনাবাহিনী এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সব ইউরোপীয় শক্তির সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং তিনি ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল আয়ত্তে নিয়ে আসেন। ১৮১২ সালে সংগঠিত বিপর্যয়কারী রুশ আগ্রাসন একটি যুগঃসন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রুশ আগ্রাসন ও ১৮১৩ সালের লিপজিগে পরাজয়ের পর ষষ্ঠ কোয়ালিশন ফ্রান্সে আগ্রাসন চালায় এবং এর ফলে নাপোলেওঁ ১৮১৪ সালের এপ্রিলে পশ্চাৎপসারণ করতে বাধ্য হন। এর কিছুদিন পরই নাপোলিও একটি অভিযান চালান, যা হান্ড্রেড ডেস নামে পরিচিত। কিন্তু ১৮১৫ সালের ১৮ই জুন তিনি ওয়াটারলুতে পরাজিত হন। তারপর তিনি জীবনের বাকি ছয় বছর ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে আটলান্টিক মহাসাগরের ছোট দ্বীপ সেন্ট হেলেনাতে কাটান।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি মিশরীয়দের মুখোমুখি সংঘর্ষের উপযোগী সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়াও যুদ্ধ-জাহাজের কামান নিয়ন্ত্রণের জন্য গোলন্দাজ বাহিনী স্থাপন করেন এবং সকল বিভাগে আদর্শ সেনাবাহিনী গড়ে তু্লেন। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে সেরা ধারণাগুলি বেছে নিয়ে অসাধারণ একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন, যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধে জয় এনে দেয়।

সেনাবাহিনীতে তার উদ্ভাবনসমূহ বর্তমানে প্রায় সকল সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি সারা বিশ্বে সর্বকালের অন্যতম সেনাপতি হিসেবে পরিচিত। নেপোলিয়ন কোড প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম সেরা কীর্তি। তিনি একটি ফ্রাঙ্কো-ফার্সি জোট গঠন করেন। দক্ষিণ ভারতের শাসক টিপু সুলতানের সাথে ফ্রাঙ্কো-ইন্ডিয়ান জোটও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ইঙ্গ -মহীশূর যুদ্ধের সময় প্রশিক্ষিত ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীও সরবরাহ করেন। ব্রিটিশদের আক্রমণের জন্য সকল প্রকার পথ উন্মুক্ত করা তার ক্রমাগত লক্ষ্য ছিল।[২][৩]

তিনি হিন্দুরাজা শিবা মহারাজের যুদ্ধনীতিরও ভুয়সী প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে সে মারাঠাদের সাথে জোট করে ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করেন। তিনি তার পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের তার অর্জিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসক ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। যদিও তাদের শাসন তার পতন ঠেকাতে পারে নি; নেপলিয়নের ভাইয়ের এক পুত্র তৃতীয় নেপোলিয়ন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্স শাসন করেন।

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

নাপোলেওঁ ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপের আজাক্সিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার জন্মের মাত্র ১ বছর আগে দ্বীপটি জেনোয়া প্রজাতন্ত্র কর্তৃক ফ্রান্সকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি ফরাসি নামের বিকল্পে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেন। বোনাপার্ট পরিবার হল মূলত লুনিজিয়ানায় বসতি স্থাপনকারী লোম্বার্ড বংশোদ্ভূত তুস্‌কান গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা ইতালির একটি অভিজাত সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচিত হতেন। পরবর্তী সময়ে এই পরিবারটি ফ্লোরেন্সে গমন করে এবং দুটি অংশে বিভক্ত হয়। এদের মধ্যে অধিক গ্রহণযোগ্য হল, বোনাপার্ট-সারজানা। তারা ফ্রান্স ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ১৬শ শতাব্দীতে তৎকালীন জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত দ্বীপ কর্সিকাতে আগমন করেন।

তার পিতা কার্লো বোনাপার্ট ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে জেনোয়া প্রজাতন্ত্রে জন্মগ্রহণ করেন। নেপোলিয়নের মা মারিয়া লেটিজিয়া রামোলিনো তার বাল্যকালে গভীর প্রভাব ফেলেন। তার বড় ভাই ছিলেন জোসেফ বোনাপার্ট। নেপোলিয়ন ছিলেন দ্বিতীয়। তার অনুজরা ছিলেন- লুসিয়েন বোনাপার্ট, এলিসা বোনাপার্ট, লুই বোনাপার্ট, পউলিন বোনাপার্ট, ক্যারোলিন বোনাপার্টজেরোমি বোনাপার্ট

পারিবারিক কারণে নেপোলিয়ন ছোটো বেলা থেকেই অন্য সাধারণ কর্সিকানদের তুলনায় শিক্ষার্জনে অধিক সুবিধা লাভ করেছিলেন। ১৭৭৯ সালের ১৫ই মে তার বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন তাকে ট্রয়েস্রের কাছে ছোট্ট শহর ব্রিয়েন লে সাঁতুঁতে অবস্থিত একটি ফরাসি মিলিটারী স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এ বিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তাকে ফরাসি ভাষা শিখতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি সারাজীবন ইতালীয় টানে কথা বলেছেন এবং কখনো ঠিকমত বানান করা শিখতে পারেন নি। প্রচলিত আছে যে, নেপোলিয়নের সেখানে প্রথম দেখা হয় শ্যাম্পেইন প্রস্তুতকারক জিন-রেমি মোয়েঁটের সাথে। এই দুজনের বন্ধুত্ব শ্যাম্পেইন এবং শ্যাম্পেন প্রস্তুতকারক এলাকার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্রিয়েনের ডিগ্রী পাওয়ার পর নেপোলিয়ন ১৭৮৪ সালে প্যারিসের এলিট রয়্যাল মিলিটারি স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাত্র ১ বছরেই দু বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন। একজন পরীক্ষক তার সম্পর্কে মন্তব্য করেন," বিমূর্ত বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত প্রাণ; অন্যান্য বিষয়ে কিছুটা আগ্রহশীল; গণিত এবং ভূগোলে ভালো জ্ঞান রয়েছে। তিনি প্রথমে নৌবাহিনী বিষয়ে আগ্রহী হলেও রয়েল মিলিটারিতে"আর্টিলারী" নিয়ে পড়াশোনা করেন।

সেনাজীবনের সূচনা সম্পাদনা

 
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ঘোড়ার চুল দিয়ে দাঁত মাজন করতেন

1786 সালে ডিগ্রী লাভ করে নেপোলিয়ন সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে ভূষিত হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সতেরো । ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত নেপোলিয়ন ভ্যালেন্স এবং এক্সনে সেনারক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী অধিকাংশ বছর তিনি করসিকাতে অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে রাজবংশীয়-বিদ্রোহী-সাধারণ কর্সিকানদের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছিল। নেপোলিয়ন জ্যাকোবিনের ফ্যাকশনকে সমর্থন করেন এবং লেফট্যানেন্ট কর্ণেল পদে ভূষিত হন। রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাস্কোয়েল প্যাইলির ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে বোনাপার্ট এবং তার পরিবার ১৭৯৩ এর জুনে ফ্রান্সে যেতে বাধ্য হন। তার কর্সিকান সহচরীদের সহযোগিতায় নেপোলিয়ন গোলন্দাজ সেনাপতি নির্বাচিত হন এবং টাউলন দখল করেন। টাউলনের উত্থান হয়েছিল প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলে এবং এটি ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল। তিনি বিচক্ষণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি l'Eguillete কেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করেন, যা পোতাশ্রয়ে ব্রিটিশ জাহাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা পোতাশ্রয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী একটি সফল আক্রমণে নেপোলিয়ন উরুতে আঘাতপ্রাপ্ত হন কিন্তু অসাধারণ কৃতিত্ব তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদ এনে দেয়। তার সাফল্য কমিটি অফ পাবলিক সেফটির দৃষ্টিগোচর হয় এবং তিনি বিদ্রোহী নেতা ম্যাক্সিমিলিয়েন রবেসপিয়েরের অনুজ অগাস্টিন রবেস্পিয়েরের একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ব্যক্তি হিসেবে রোবসপিয়ার সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। চরিত্র ছিল তাঁর নিষ্কলঙ্ক।

নারীজাতির থেকে তিনি দূরে থাকতেন। জানা যায় যে তিনি নিজের ভগিনী শার্লোত কেও পর্যন্ত ঘৃণা করতেন।

নিজের মতকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন।

তাঁর মতে সমাজকে সততা ও ন্যায় নীতির মাধ্যমেই শাসন করা উচিত। আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর।

তাঁর নিষ্ঠুরতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি বহু মানুষকে গিলোটিনে হত্যা করেছিলেন।

নিজে সৎ হওয়ায় তিনি চাইতেন প্রত্যেকেই সৎ হতে বাধ্য। তাই সততা তাঁর চরিত্রের বড় একটি দিক। এর ফলস্বরূপ, বড় রবেস্পিয়েরের পতনের পর ১৭৯৪ সালের ৬ আগস্ট কারাগার বন্দী হন কিন্তু দুই সপ্তাহ পরই নেপোলিয়ন ছাড়া পান।

হুইফ অফ গ্রেপশট সম্পাদনা

১৭৯৫ সালের ৩ অক্টোবর রাজপক্ষীয়রা এবং বিদ্রোহের বিরোধীরা জাতীয় কনভেনশনের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে। নেপোলিয়নকে টুইলারিস(Tuileries) প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত কনভেনশনের রক্ষায় গঠিত বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি জোয়েচিম মুরাট (Joachim Murat) নামক একজন তরুণ কর্মকর্তাকে নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর বিভিন্ন অংশকে একত্র করেন। তিনি এই বাহিনীকে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেন। তিনি পরে একে এভাবে ব্যাখা করেন যে তিনি হুইফ অফ গ্রেপশট-এর মাধ্যমে পথ পরিষ্কার করেছেন। এই সঘর্ষ সমগ্র ফ্রান্সেই বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ অসাধারণ বিজয় তাকে অনেক খ্যাতি এনে দেয়। তিনি নতুন ডিরেক্টরির নেতা বারাসের (barras) সমর্থন পান। কিছুদিন পরেই তিনি বারাসের প্রাক্তন স্ত্রী জোসেফাইন দ্য ব্যুহ্যারানাইস (Josephine de Beauharnais) কে ১৭৯৬ সালের ৯ মার্চ বিবাহ করেন।

ইতালিতে সামরিক তৎপরতা (১৭৯৬-৯৭) সম্পাদনা

বিয়ের পরেই ১৭৯৬ সালের ২৭ মার্চ নেপোলিয়ন ফরাসি আর্মি অফ ইতালির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফলতার সাথে ইতালি আক্রমণ করেন। লোডিতে(Lodi) তিনি দি লিট্‌ল করপোরাল(le petit caporal) উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি তার প্রায় সমস্ত সৈন্যকে খুব ভালোভাবে চিনতেন। তা থেকে ধারণা করা যায় সতীর্থদের সাথে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা। তিনি লোম্বার্ডি থেকে অস্ট্রিয়ানদের বিতাড়িত করেন এবং পাপাল প্রদেশের(Papal States) সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এর কারণ ছিল, পোপ পিউস ৬(Pope Pius VI) কর্তৃক লুইস ১৬ (Louis XVI) এর কর্মকান্ডের প্রতিরোধ, ফ্রান্স কর্তৃক দুটি ক্ষুদ্র পাপাল ভূখন্ডের দখল। নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ এবং পোপকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ডিরেক্টরির আদেশ অগ্রাহ্য করেন। অবশ্য পরের বছরই জেনারেল বার্থিয়ের(General Berthier) ইতালি দখল করে নেন এবং ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখ পোপকে বন্দী করেন। সেখানেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে পোপ মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৯৭ সালের শুরুতেই নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করেন এবং তার শক্তিকে শান্তির জন্য কাজে লাগান। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্স উত্তর ইতালির অধিকাংশই দখল করে নেয়। নিচুদেশসমূহ এবং রাইনল্যান্ডও ফ্রান্সের অধিকারে আসে। কিন্তু তখনো ফ্রান্স ভেনিস অধিকার করতে পারেনি। নেপোলিয়ন এরপর ভেনিসে গমন করেন এবং ভেনিস আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এভাবে এক সহস্র বছরের স্বাধীন ভেনিসের পতন হয়। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালেই নেপোলিয়ন ইতালির ফ্রান্স শাসিত রাজ্যসমূহ নিয়ে সিজালপাইন রিপাবলিক (Cisalpine Republic) গড়ে তুলেন।

নেপোলিয়নের সামরিক তৎপরতাসমূহ তার বাস্তবক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগের অসীম জ্ঞানেরই প্রতিফলন ঘটায়। নেপোলিয়নের ভাষায়ঃ

মিশরে সামরিক তৎপরতা (১৭৯৮-৯৯) সম্পাদনা

১৭৯৮ সালের মার্চে বোনাপার্ট মিশর দখলের জন্য সামরিক অভিযান প্রস্তাব করেন। তখন উসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ কখন আক্রমণ করতে হবে সেটা সম্পর্কে নেপোলিয়নের অবিশ্বাস্য রকম কল্পনা শক্তি ছিল। নেপোলইয়ন প্রায়সময় গুপ্তচর নিয়োগ করে শত্রুপক্ষের গোপন খবর রাখতেন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।

ধারণা ও বিশ্বাস সম্পাদনা

নেপোলিয়ন ১৭৭১ সালের ২১ জুলাই আজাকিকোতে ব্যাপ্টিস্ট মতবাদে দীক্ষা নেন; তিনি একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠেন কিন্তু যথেষ্ট ধর্মবিশ্বাস তার ছিল না। [৪] পরিণত বয়সে [৫] তাঁর উপাস্য ছিল অদৃশ্য ও অধরা ঈশ্বর। তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রে তিনি সংঘবদ্ধ ধর্মীয় শক্তির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন এবং নিজ লক্ষ হাসিলের জন্য তিনি তা প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট মনযোগী ছিলেন। নিজের উপর ক্যাথলিক রীতিনীতি ও চমৎকারিত্বের প্রভাব উল্লেখ করেন তিনি।[৪]

নেপলিয়ান জোসেফিন ডি বেহার্নেসকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় বিয়ে করেন। মিশর অভিযানের সময় নেপলিয়ান একজন বিপ্লবী সেনাপ্রধান হিসাবে যথেষ্ট ধর্মীয় উদারতা প্রকাশ করেন। ওলামাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং ধর্মীয় উদযাপনের নির্দেশ দেন; কিন্তু পোপ ষষ্ঠ পায়াসের মৃত্যু হওয়ার পর তার প্রধান সহকারী তার এ আচরণকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করেন: "আমরা তাদের ধর্মের প্রতি মিছে আগ্রহ দেখানোর ভান করে মিশরীয়দের বোকা বানাই। তিনি ও আমি কেউই এই ধর্ম ততটা বিশ্বাস করি না, যতটা পায়াস দ্য ডিফাংটের ধর্মে করি।"[note ১]

নিজ স্মৃতিচরণে বোনপর্তের সচিব বোরিন বেনাপার্টের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে একই মন্তব্য লেখেন।[৭] তার ধর্মীয় সুযোগগ্রহণের কৌশল তার এই বিখ্যাত উক্তিতে ফুটে উঠেছে: "নিজেকে ক্যাথলিক বানানোর মাধ্যমে আমি ব্রিটানি ও ভ্যান্ডিতে শান্তি এনেছি। নিজেকে ইতালীয় বানানোর মাধ্যমে আমি ইতালিতে সকলের মন জয় করেছি এবং নিজেকে মুসলিম বানিয়ে আমি মিশরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং আমি যদি ইহুদিদের শাসক হতাম, তবে সলোমনের মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতাম।"[৮] তবে জোয়ান কোরের মতে, "সে তুলনায়, নবী মুহাম্মদের জন্য বোনপোর্টের প্রশংসা ছিল খুবই খাঁটি।"[৯] সেন্ট হেলেনায় তার বন্দিদশায় থাকাকালীন ভলতেয়ারের সমালোচনামূলক মঞ্চনাটক মাহোমেটে নবী মুহাম্মাদ সা.-কে নেতিবাচক চিত্রায়নের কঠোর সমালোচনা করেন।[১০]

নেপোলিয়ন হিন্দু ধর্মের প্রতিও বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন এবং হিন্দুরাজা শিবা মহারাজের ভূয়সী প্রসংসা করেন। তিনি ১৮০৪ সালের ১-২রা ডিসেম্বর প্যারিসের নটরডেমে পোপ ৭ম পায়াস কর্তৃক 'সম্রাট নেপোলিয়ন' উপাধি লাভ করেন। ১৮১০ সালে অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা ম্যারি লুইকে তিনি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বিয়ে করেন। ১৮১৩ সালে স্পেনে তার ভাইয়ের শাসনকালীন তিনি স্প্যানিশ ইনকুইজিশন প্রথা বিলুপ্ত করেন।

সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত হিসেবে অবস্থানকালে তিনি জেনারেল গরগারডের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মানুষের উৎপত্তি নিয়ে তার অধিবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন[note ২] এবং যীশুর স্বর্গীয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এই বলে, রোমান ক্যাথলিক না হওয়ার কারণে সক্রেটিস, প্লেটো, মুসলিম ও অ্যাংলিকানরা ধ্বংস হয়ে যাবে এমনটা বিশ্বাস করা খুবই হাস্যকর। [note ৩] ১৮১৭ সালে তিনি গর্গার্ডকে আরও বলেন যে "আমি মুহাম্মদীয় ধর্মটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এতে অল্প হলেও কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের ধর্মের থেকে অধিক শক্তিশালী।"[১২] আরো বলেন যে, "সকল ধর্মের মাঝে মুহাম্মদীয় ধর্ম সবচেয়ে উত্তম।"[১৩] তবে মৃত্যুর পূর্বে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকই তাকে গোসল করিয়েছিলেন।[১৪]

মৃত্যু সম্পাদনা

১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকেন। এরের ৫ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ শব্দগুলো ছিল, "ফ্রান্স, ল'আর্মি, তেতে দ'আর্মি, জোসেফিনে" ( অনুবাদ : "ফ্রান্স, সেনাবাহিনী, সেনা প্রধান, জোসেফিনে")। [১৫][১৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Dwyer 2008a, পৃ. xv।
  2. The Islamic world in decline by Martin Sicker p.97
  3. Kaushik Roy, War, Culture and Society in Early Modern South Asia, 1740–1849, (Routledge, 2011), 77.
  4. "L'Empire et le Saint-Siège"। Napoleon.org। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০১১ 
  5. Stephen Coote (২০০৫)। Napoleon and the Hundred Days। Perseus। পৃষ্ঠা 28। ৪ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুলাই ২০১৬ 
  6. Jacques Bainville, Napoleon I, p.94
  7. "Bonaparte and Islam."। Center for History and New Media at George Mason University। ২৮ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুলাই ২০১২ 
  8. "Napoleon: Man of Peace"। Napoleon-series.org। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯। ১১ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ নভেম্বর ২০১১ 
  9. Juan Cole, Napoleon's Egypt: Invading the Middle East, Palgrave Macmillan, 2007, p.29
  10. Memoirs of the Life, Exile, and Conversations of the Emperor Napoleon, volume 2, Emmanuel-Auguste-Dieudonné comte de Las Cases, Redfield, 1855, p.94
  11. Gourgaud 1903, পৃ. 276–277
  12. Gourgaud 1903, পৃ. 274–275
  13. Gourgaud 1903, পৃ. 279–280
  14. Louis Antoine Fauvelet de Bourrienne, Memoirs of Napoleon Bonaparte। Scott, Webster & Geary। ১৮৩৯। পৃষ্ঠা 586। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ 
  15. McLynn 1998, পৃ. 655
  16. Roberts, Napoleon (2014) 799-এ801

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. ইংরেজি: /nəˈpliən ˈbnəpɑːrt/
  2. এই ফরাসি ব্যক্তিনামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপিডিয়া:বাংলা ভাষায় ফরাসি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
    ফরাসি: Napoléon Bonaparte, ফরাসি উচ্চারণ: ​[napɔleɔ̃ bɔnapaʁt]
    কর্সিকান: Napulione Buonaparte
  1. "Nous trompons les Égyptiens par notre simili attachement à leur religion, à laquelle Bonaparte et nous ne croyons pas plus qu'à celle de Pie le défunt."[৬]
  2. "I think the matter that made man was slime, warmed by the sun and vivified by electric fluids. What are animals—an ox, for example—but organized matter? Well, when we see that our physical frame resembles theirs, may we not believe that we are only better organized matter. … The most simple idea consists in worshiping the sun, which gives life to everything. I repeat, I think man was created in an atmosphere warmed by the sun, and that after a certain time this productive power ceased."[১১]
  3. "I do not think Jesus Christ ever existed. I would believe in the Christian religion if it dated from the beginning of the world. That Socrates, Plato, the Mohammedan, and all the English should be damned is too absurd. Jesus was probably put to death, like many other fanatics who proclaimed themselves to be prophets or the expected Messiah. Every year there were many of these men."[১১]