গাজন উৎসব

পশ্চিমবঙ্গের লোক-উৎসব

গাজন উৎসব ভারতের পশ্চিমবঙ্গেবাংলাদেশে উদযাপিত একটি হিন্দুধর্মীয় লোকউৎসব। এই উৎসব শিব, নীল, মনসাধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রিক উৎসব। মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা এবং জলপাইগুড়িতে গমীরাচৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। ধর্মের গাজন সাধারণত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। চৈত্রমাস ছাড়া বছরের অন্যসময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে তাকে হুজুগে গাজন বলা হয়। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা।

গাজন
হাওড়ার নরনা গ্রামে গাজন উৎসব
অন্য নামশিবগাজন
পালনকারীপূর্ব ভারতের হিন্দু ও উপজাতীয় ব্যক্তি
ধরনসাংস্কৃতিক
তাৎপর্যশিবহরকালীর বিবাহ
শুরুচৈত্রের শেষ সপ্তাহ
সংঘটনবার্ষিক
সম্পর্কিতশিব

গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তারা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। শিবের গাজনে দু'জন সন্ন্যাসী শিবগৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করতে থাকেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা (কালিকা পাতারি নাচ)। জ্যৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে।[১]

নামকরণ সম্পাদনা

বাংলা গাজন শব্দটি গর্জন শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরূপ নামকরণ হয়।[২] অপর মতে, গা শব্দের অর্থ গ্রাম এবং জন শব্দের অর্থ জনসাধারণ; গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের এই রূপ নামকরণ হয়।[৩]

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। অন্যদিকে, ধর্মঠাকুরের গাজন হল ধর্মঠাকুর ও দেবী কামিনী-কামাখ্যার (বাঁকুড়া জেলা), দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব।[২]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
১৮৪৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত চড়ক উৎসবের চিত্র

রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে ‘গাজন’। গাজন অর্থে (গাঁ= গ্রাম, জন= জনগণ) গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব। নবদ্বীপ মহিমার লেখক কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি ‘গাজন’-কে ধর্মগাজনের অপভ্রংশ বলেছেন।

গাজন বিষয়ে ভারতকোষকার জানিয়েছেন, "বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব। ইহা নিম্নশ্রেণির লোকের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ...বাংলাদেশে ইহা নানা পৌ্রাণিক ও লৌকিক দেবতার নামের সহিত যুক্ত হইয়াছে, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।"[৪]

যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

নবদ্বীপে গাজন সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নবদ্বীপের শিবলিঙ্গগুলি বেশিরভাগই বৌদ্ধ প্রভাবিত। পাল যুগে নবদ্বীপ ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান। নবদ্বীপের পশ্চিমে একটি ঢিবি ছিল; তার পূর্ব নাম ‘পারডাঙা’, বর্তমানে ‘পাড়পুর’। নবদ্বীপের বৌদ্ধ-প্রভাবিত শিবমূর্তিগুলি পারডাঙার ধ্বংস স্তুপ থেকে প্রাপ্ত। নবদ্বীপের পূর্বে অবস্থিত ‘বল্লালসেনের ঢিবি’ খননের পর প্রাপ্ত স্থাপত্য শৈলীকে অনেকে বৌদ্ধ মন্দির বলে মনে করেছেন।[৫] পানশিলা সুবর্ণবিহার নবদ্বীপের সন্নিকটে অবস্থিত। নবদ্বীপের বুড়োশিব, যোগনাথ, বানেশ্বর, হংসবাহন, পারডাঙার শিব প্রভৃতি এই শ্রেণির বৌদ্ধ প্রভাবিত শিবলিঙ্গ। এঁদের কোন গৌরীপট্ট নেই।
নবদ্বীপে শিবের সংখ্যা অনেকগুলি — বুড়োশিব, যোগনাথ, বানেশ্বর, দণ্ডপাণি, হংসবাহন, অলকনাথ, বালকনাথ, ভবতারণ, পোলোশ্বর। এর মধ্যে ভবতারণ ও অলোকনাথ ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির চিহ্ন যুক্ত প্রতিষ্ঠিত শিব — নদিয়ার রাজারা এই দুই শিবের প্রতিষ্ঠাতা। অলকনাথ প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়; আর ভবতারণ প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজ গিরিশচন্দ্র রায়(১৮২৫ খ্রি)। ভবতারণ শিবের গাজন হয় না। বালকনাথ শিব কুড়িয়ে পেয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্যামাচরণ দাস। পোলো দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে যে মূর্তি পাওয়া যায়, তার নাম পোলোশ্বর শিবহংসবাহন শিব সারাবছর হংসদার বিলে নিমজ্জিত থাকেন, গাজনের কদিন মন্দিরে অধিস্থান করেন। আদিতে এটা ছিল বৌদ্ধ মূর্তি, হংসের উপর স্থাপিত প্রস্তর নির্মিত 'পঞ্জর' চিহ্নযুক্ত শিলাটি এখন শিব রূপে পূজিত হচ্ছেন।
গাজনের পাঁচ দিন নবদ্বীপের আপামর জনগণ মেতে ওঠেন উৎসবে। সাতগাজন, ফুল-ফল, নীলচড়ক — এই নিয়ে পালিত হয় গাজন।

কালীর গাজন সম্পাদনা

গাজন উৎসবে সাধারণত শৈব সংস্কৃতির অংশ হলেও বর্ধমানের মন্তেশ্বর গ্রামে গাজন উৎসবে কালীর আরাধনা করা হয়। প্রায় চারশো বছর ধরে এখানে এই ব্যতিক্রমী রীতি পালন হয়ে আসছে। ব্যাতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে মানুষই কালীর বেশে আরাধ্য হন। এছাড়াও কালী ঠাকুরের চ্যালাচামুণ্ডা ও শিবের মুখোশ পরে নাচগান, সাধন-ভজন হয়ে থাকে।[৬]

বাংলার অন্যান্য স্থানের গাজন সম্পাদনা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ চৈত্রসংক্রান্তিতে হুগলি জেলার তারকেশ্বর তারকনাথ শিব, পূর্ব বর্ধমান জেলার কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিব ও করুইের বুড়োশিব, বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর শিব বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ষাঁড়েশ্বর শিব ও বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার বুনোঠাকুর শিবের গাজন; জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরাতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরএ অযোধ্যাগ্রামের মনসার গাজন এবং আষাঢ়ি পূর্ণিমায় বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজন বিখ্যাত। কলকাতায় গাজন উৎসবে এককালে কাঁসারিপাড়া ও জেলেপাড়ার সঙ বিখ্যাত ছিল। বাঁকুড়ার ছাতনা থানার ঝাঁটিপাহাড়ী গ্রামে জ্যৈষ্ঠ মাসের ২৫/২৬ তারিখে শিবকেন্দ্রিক হুজুগে গাজন বিখ্যাত; এখানকার মেলায় আদিবাসী নৃত্য বিশেষ আকর্ষণ।

বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজনে তিনটি প্রমাণ সাইজের কাঠের ঘোড়ার উপরে মহামানস, স্বরৃূপনারায়ণ ও ধর্মরাজ (যথাক্রমেঃ বুদ্ধ, সংঘ ও ধর্ম)কে চড়িয়ে অসংখ্য ভক্ত-সন্ন্যাসী ও মাথায় জ্বলন্ত ধুনোর খোলা নিয়ে ব্রতচারিণীদলের শোভাযাত্রা বেরোয়। পূর্ব বর্ধমানের কুরমুনের গাজনে সন্ন্যাসীদের মুখে রং মেখে সঙ সেজে ও শ্মশান সন্ন্যাসীদের নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্য লক্ষ্যণীয়; কুরমুনের মেলায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি পুতুলের কলানৈপুণ্যের প্রতিযোগিতা আকর্ষণীয়। করুইে নীল পুজোর দিন বুড়োশিবকে সারা বছর পর শিবপুকুর থেকে তোলা হয় এবং বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে গ্রাম পরিক্রমা করানো হয়৷ গ্রাম ঘুরে আটনে বসিয়ে আতশ বাজি প্রদর্শন করা হয় সেখানে বহু মানুষের সমাগম হয়; এছাড়াও হর-পার্বতী এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়৷ফরিদপুরে কোটালিপাড়ার গাজনে মৃত্তিকানির্মিত বিরাট শিবমূর্তির সামনে বলি দেওয়া এবং বলির রক্তে মূর্তিকে স্নান করানো বিশেষ বৈশিষ্ট্যময়। [১]

ছড়া গানে গাজন সম্পাদনা

ছড়া গানেও প্রবেশ শিবের গাজন —
‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই।
ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।।’

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ২৯৫-২৯৬
  2. Mitra, Dr. Amalendu, Rarher Sanskriti O Dharmathakur, First published 1972, 2001 edition, pp. 165-169, Subarnarekha, 73 Mahatma Gandhi Road, Kolkata
  3. Ghosh, Binoy, Paschim Banger Sanskriti, (in Bengali), part I, 1976 edition, p. 67, Prakash Bhaban
  4. ভারতকোষ- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০০-১০১
  5. ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকায় নদিয়া জেলা সংখ্যায় প্রকাশিত মোহিত রায়ের প্রবন্ধ, পৃ. ৫৩
  6. "এ গাজন শিবের নয় কালীর - INCEP NOW"Dailyhunt (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-০৪ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা