কাপ্তাই বাঁধ

বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত একটি বাঁধ

কাপ্তাই বাঁধ বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত ও চট্টগ্রাম থেকে ৬৫ কিলোমিটার (৪০ মাইল) উজানে কর্ণফুলি নদীর উপর নির্মিত একটি বাঁধকাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিত এটির একটি কৃত্রিম জলাধার রয়েছে যার পানি ধারণক্ষমতা ৫২,৫১,০০০ একর (২১,২৫,০০০ হেক্টর)। বাঁধ ও হ্রদটি নির্মাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ১৯৬২ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়।[১] বাঁধের সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ১৯৬২ ও ১৯৮৮ সালের মধ্যে এখানে সর্বমোট ২৩০ মেগাওয়াট (৩,১০,০০০ অশ্বশক্তি) বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর বসানো হয়। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম বাঁধ ও একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র[২]

কাপ্তাই বাঁধ
২০২০ সালে কাপ্তাই বাঁধ
কাপ্তাই বাঁধ বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
কাপ্তাই বাঁধ
কাপ্তাই বাঁধ অবস্থানের বাংলাদেশ
দেশবাংলাদেশ
অবস্থানকাপ্তাই, রাঙ্গামাটি জেলা
স্থানাঙ্ক২২°২৯′৪০.১১″ উত্তর ৯২°১৩′৩১.৫৩″ পূর্ব / ২২.৪৯৪৪৭৫০° উত্তর ৯২.২২৫৪২৫০° পূর্ব / 22.4944750; 92.2254250
উদ্দেশ্যবিদ্যুৎ উৎপাদন
অবস্থাক্রিয়াকলাপ
নির্মাণ শুরু১৯৫৭
উদ্বোধনের তারিখ১৯৬২
বাঁধ এবং অতিরিক্ত জলনির্গমপথ
বাঁধের ধরনবাঁধ
আবদ্ধতাকর্ণফুলী নদী
উচ্চতা৪৫.৭ মিটার (১৫০ ফুট)
দৈর্ঘ্য৬৭০.৬ মিটার (২,২০০ ফুট)
প্রস্থ (চূড়ায়)৭.৬ মিটার (২৫ ফুট)
প্রস্থ (ভিত্তিতে)৪৫.৭ মিটার (১৫০ ফুট)
বাঁধের আয়তন১৯,৭৭,০০০ ঘনমিটার (৬,৯৮,০০,০০০ ঘনফুট)
অতিরিক্ত জলনির্গমপথের ধরননিয়ন্ত্রিত, ১৬টি গেট
অতিরিক্ত জলনির্গমপথের ধারণক্ষমতা১৬,০০০ ঘনমিটার প্রতি সেকেন্ড (৫,৭০,০০০ ঘনফুট/সেকেন্ড)
জলাধার
তৈরিকাপ্তাই হ্রদ
মোট ধারণক্ষমতা৬,৪৭,৭০,০০,০০০ ঘনমিটার (৫২,৫১,০০০ acre feet)
অববাহিকার আয়তন১১,০০০ বর্গকিলোমিটার (৪,২০০ বর্গমাইল)
পৃষ্ঠতলের আয়তন৭৭৭ বর্গকিলোমিটার (৩০০ বর্গমাইল)
সাধারণ উচ্চতা৩৩ মিটার (১০৮ ফুট)
পাওয়ার স্টেশন
সম্পাদনের তারিখ১৯৬২, ১৯৮২, ১৯৮৮
ঘূর্ণযন্ত্র২ x ৪০ মেগাওয়াট (৫৪,০০০ অশ্বশক্তি), ৩ x ৫০ মেগাওয়াট (৬৭,০০০ অশ্বশক্তি) কাপলান-টাইপ
স্থাপিত ক্ষমতা২৩০ মেগাওয়াট (৩,১০,০০০ অশ্বশক্তি)

এছাড়া এখানে ‘কাপ্তাই ৭.৪ মেগাওয়াট সোলার পিডি গ্রিড কানেকটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র' নামে দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে বাঁধের পাশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থান।[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
১৯৬৫ সালে কাপ্তাই বাঁধ

১৯০৬ সালে কর্ণফুলি জলবিদুৎ প্রকল্প সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করা হয় এবং সে সময়ে এ লক্ষ্যে একটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক সমীক্ষা চালানো হয়। ১৯২৩ সালে এ ধরনের আরেকটি সমীক্ষা চালানো হয়। ১৯৪৬ সালে, ই.এ. মুর কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদনে বর্তমান বাঁধের অবস্থান থেকে ৬৫ কিমি উজানে বরকলে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৫০ সালে, প্রকৌশল পরামর্শক সংস্থা মার্জ রেনডাল ভ্যাটেন কাপ্তাই থেকে ৪৮ কিলোমিটার (৩০ মাইল) উজানে চিলারডাকে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করে।

১৯৫১ সালে, সরকারি প্রকৌশলীগণ কাপ্তাই থেকে ১১ কিলোমিটার (৬.৮ মাইল) ভাটিতে চিতমোরামে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করে। ১৯৫১ সালে, সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী খাজা আজিমুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বাঁধ নির্মাণের স্থান হিসেবে কাপ্তাইকে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

নির্মাণ সম্পাদনা

তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কার্য শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়।[৪] ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট এ বাঁধটি নির্মাণ করে। সে সময় বাঁধে, পানি নির্গমন পথ, জলকপাট এবং দুটি ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কাপলান টারবাইন জেনারেটর নির্মিত হয়। প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এই প্রকল্পটির অর্থায়ন করে পূর্ব পাকিস্তান সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিদেশী অর্থনৈতিক সহযোগিতা তহবিল।

১৯৮২ সালের আগস্টে, এখানে একটি ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে, চতুর্থ এবং পঞ্চম উৎপাদক ইউনিটে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কাপলান ধরনের টারবাইন স্থাপন করা হয়; যার ফলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।[৫]

বিবরণ সম্পাদনা

 
কাপ্তাই হ্রদে নৌকা

মাটি ভরাটের মাধ্যমে এই বাঁধটি নির্মিত হয়েছে। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ৬৭০ মিটার (২,২০০ ফুট) ও প্রশস্ত ৪৫.৭ মিটার (১৫০ ফুট)। এর ভিত্তিস্তর এবং উপরিতলের প্রশস্ততা যথাক্রমে ৪৫৭ মিটার এবং ৭.৬ মিটার। বাঁধটি সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩৬ মিটার উপরে অবস্থিত। পানি নির্গমনের জন্য বাঁধের বাঁদিকে ২২৭ মিটার দীর্ঘ আলাদা নির্গমপথ রয়েছে, যা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১৬,০০০ ঘন মিটার পানি নির্গত হতে পারে। নির্গমপথে ১৬টি পরপর আলাদা দরজা যুক্ত রয়েছে, যার প্রতিটির মাপ ১২.২ মিটার × ১১.৫ মিটার।

প্রভাব সম্পাদনা

বাঁধটি নির্মাণের ফলে ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার (২৫৩ বর্গমাইল) অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হয়। কাপ্তাই এলাকার স্থায়ী উপজাতিরা এই বাঁধ নির্মাণের ফলে তারা তাদের বাড়ী-ঘর এবং চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়েছেন। প্রায় ১৮,০০০টি পরিবার এবং ১,০০,০০০ জন উপজাতি বাস্তুচ্যুত হতে হয়। চল্লিশ হাজারেরও অধিক চাকমা উপজাতি সম্প্রদায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্থানান্তরিত হয়। জমি অধিগ্রহণের ফলে ঐ এলাকায় সৃষ্ট সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।[৬] এছাড়াও, এ বাঁধ নির্মাণজনিত কারণে জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। বন্যপ্রাণী এবং তাদের বসবাস উপযোগী আবাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বাংলাদেশের বৃহত্তম, সর্বোচ্চ, দীর্ঘতম ও ক্ষুদ্রতম"বাংলানিউজ২৪.কম। ১৮ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১২ 
  2. সাইলা পারভীন, আই. এম. ফয়সাল (২১ জুলাই ২০১০)। "People versus Power: The Geopolitics of Kaptai Dam in Bangladesh"। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ওয়াটার রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট১৮: ১৯৭–২০৮। ডিওআই:10.1080/07900620220121756 
  3. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "সরকারি সৌরবিদ্যুৎ প্রথম যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে"প্রথম আলো 
  4. দৈনিক যায়যায়দিন, জানুয়ারি ১০, ২০০৮, পৃষ্ঠা: ১০, মুদ্রিত সংস্করণ
  5. "Power Plants" (পিডিএফ)বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। মার্চ ২০১০। ২৬ মে ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০১৩ 
  6. ""The construction of the Kaptai dam uproots the indigenous population (1957-1963)". Retrieved 2007-02-01."। ২০১২-০২-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-০১ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা