রঞ্জন-রশ্মি বিকিরণকারী যুগ্ম তারা

দ্বৈত তারার শেণি
(এক্স-রশ্মি বিকিরণকারী জোড়াতারা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

এক্স-রে দ্বৈত তারা হল দুটি মহাজাগতিক উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি এক শ্রেণির যুগ্মতারা যারা রঞ্জন রশ্মি বা এক্স-রে বিকিরণ করে। এক্ষেত্রে একটি উপাদান থেকে অন্য আরেকটি উপাদানে বিভিন্ন বস্তু পতিত হয়ে এক্স-রে উৎপন্ন করে। এখানে প্রথম উপাদানটিকে ডোনার বা দাতা এবং অন্য উপাদানটিকে এক্রেটর বলা হয়। সাধারণত, দাতা উপাদানটি একটি অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক তারা হয়ে থাকে, এবং এক্রেটর উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট কোন তারা যেমন, নিউট্রন তারকা বা কৃষ্ণগহ্বর বা কমপ্যাক্ট তারা হয়ে থাকে। পতিত বস্তু তার স্থিতি ভরের কয়েক দশক শতাংশ মহাকর্ষীয় বিভব শক্তি, এক্স-রে রূপে বিকিরণ করে (যেখানে, হাইড্রোজেন ফিউশন এর ফলে স্থিতি ভরের মাত্র ০.৭ শতাংশ নিঃসৃত হয়)। এক্স-রে দ্বৈতের জীবনকাল এবং ভর-স্থানান্তরের হার নির্ভর করে দাতা তারকার বিবর্তনীয় অবস্থা, দাতা ও এক্রেটরের ভরের অনুপাত এবং এদের কক্ষীয় বিচ্ছিন্নতার উপর। [১]

শিল্পীর কল্পনায় রঞ্জন-রশ্মি বিকিরণকারী জোড়াতারা

একটি নিম্ন ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা থেকে প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক প্রায় ১০৪১ টি পজিট্রন নির্গত হয়। [২][৩]

শ্রেণিবিন্যাস সম্পাদনা

 
মাইক্রোকোয়াসার এসএস-৪৩৩

এক্স-রে দ্বৈত তারাকে আরও কয়েকটি উপশ্রেণীগুলিতে বিভক্ত করা হয়, যার ফলে সম্ভবত এর অন্তর্নিহিত ঘটনা আরও ভালভাবে প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য যে, শ্রেণিবিন্যাসটি দৃশ্যমান দাতা উপাদানের ভর (উচ্চ, মধ্যবর্তী, নিম্ন) এর ভিত্তিতে করা হয়েছে, উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট এক্স-রে নির্গমনকারী এক্রেটরের ভরের ভিত্তিতে নয়।

নিম্ন ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা সম্পাদনা

নিম্ন ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা (এলএমএক্সবি) হচ্ছে একটি যুগ্ম তারকা ব্যবস্থা যেখানে উপাদানগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে কালো গহ্বর বা নিউট্রন তারকা[১] সাধারণত, দাতা তারাটি নিজেই নিজের রোচে লোবে অঞ্চল বা মহাকর্ষীয় এলাকা দখল করে নেয় এবং অধিক ঘনত্ববিশিষ্ট এক্রেটর উপাদানটিতে (নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণ গহ্বর) বিভিন্ন বস্তু স্থানান্তর করে। এলএমএক্সবি ব্যবস্থায় দাতা তারাটি এক্রেটরের চেয়ে আকারে ছোট হয়। এটি একটি মেইন-সিকোয়েন্স তারা, একটি ক্ষয়িত বামন (শ্বেত বামন) অথবা বিবর্তিত তারা (লোহিত দানব) হতে পারে। আকাশগঙ্গা ছায়াপথে প্রায় দুইশত এলএমএক্সবি শনাক্ত করা হয়েছে,[৮] এবং এদের মধ্যে ১৩ টি এলএমএক্সবি গ্লোবিউলার গুচ্ছে অবস্থিত। চন্দ্র এক্সরে অবজারভেটরি বহু দূরবর্তী ছায়াপথে এলএমএক্সবি আবিষ্কার করেছে।

একটি সাধারণ নিম্ন-ভর এক্স-রে দ্বৈত তারা এর প্রায় সমস্ত বিকিরণ এক্স-রে রূপে নির্গত করে এবং সাধারণত এক শতাংশেরও কম দৃশ্যমান আলোরূপে বিকিরণ করে। তাই এরা এক্স-রে আকাশে সবথেকে উজ্জ্বল বস্তুর মধ্যে হলেও, দৃশ্যমান আলোতে অপেক্ষাকৃত ঝাপসা থাকে। এদের আপাত মান সাধারণত ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে হয়। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ হল এক্রেটর উপাদানটির চারপাশে তৈরি হওয়া বিবৃদ্ধি চাকতি। এলএমএক্সবি এর কক্ষীয় পর্যায়কাল দশ মিনিট থেকে শত শত দিন পর্যন্ত হতে পারে।

এলএক্সএমবি সাধারণত এক্স-রে নিঃসারকরূপে পাওয়া গেলেও, কখনও কখনও এক্স-রে পালসার হিসেবেও এদের দেখা যায়। হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম এর সংযোগের ফলে তৈরি তাপীয়পারমাণবিক বিস্ফোরণের দ্বারা এক্স-রে নিঃসারক তৈরি হয়। [৯]

মাঝারি ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা সম্পাদনা

মাঝারি ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা ( আইএমএক্সবি ) হচ্ছে একটি যুগ্ম তারা ব্যবস্থা যেখানে এক্রেটর উপাদান হচ্ছে নিউট্রন তারকা বা একটি কালো গহ্বর। অন্য উপাদানটি হল একটি মাঝারি ভরবিশিষ্ট সাধারণ তারা। [৯][১০] মাঝারি ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা থেকে নিম্ন-ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারকা ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়।

উচ্চ ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা সম্পাদনা

উচ্চ ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারা (এইচএমএক্সবি) হচ্ছে একটি যুগ্ম তারকা ব্যবস্থা যা শক্তিশালী এক্স রে নিঃসৃত করে এবং যার দাতা উপাদানটি একটি বৃহৎ তারকা। সাধারণত এটি একটি "ও" বা "বি" তারকা, অথবা একটি নীল অতিদানব হয়ে থাকে। ঘনীভূত, এক্স-রে নির্গমনকারী উপাদানটি হয় নিউট্রন তারকা বা কালো গহ্বর[১] অতিদানব স্বাভাবিক তারাটির নাক্ষত্র ঝড়ের কিছু অংশ ঘনীভূত বস্তুটি আকর্ষণ করে এবং সেগুলো এতে পতিত হওয়ার ফলে এক্স-রে উৎপাদন করে।

একটি উচ্চ-ভর এক্স-রে দ্বৈতে, বড় তারাটি দৃশ্যমান আলোর নির্গমনকে প্রভাবিত করে, এবং ঘনীভূত বস্তুটি এক্স-রে নির্গমনের প্রধান উৎস। এক্ষেত্রে দাতা উপাদানটি খুব উজ্জ্বল হওয়ার ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। সবচেয়ে বিখ্যাত উচ্চ-ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারার একটি হল সিগন্যাস এক্স-১, যা শনাক্ত হওয়া প্রথম কালো গহ্বর। অন্যান্য উচ্চ-ভর এক্স-রে দ্বৈতের মধ্যে রয়েছে ভেলা এক্স-১ ( ভেলা এক্স পালসার নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না), এবং ৪ইউ ১৭০০-৩৭

অনেক সময় উচ্চ-ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত, এক্স-রে নিঃসারক না হয়ে এক্স-রে পালসারও হতে পারে। উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট এক্রেটরের মেরুতে চৌম্বক ফানেলের মত বিভিন্ন বস্তুর সংযোজনের কারণে এক্স-রে পালসারগুলো তৈরি হয়। [৯] বৃহৎ আকারের দাতা তারাগুলোর নাক্ষত্র ঝড়, তার মহাকর্ষীয় এলাকা ছাড়িয়ে এত বৃহৎ পরিমাণে প্রসারিত হয় যে, ভরের স্থানান্তরে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় এবং খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটে থাকে।

উচ্চ-ভরবিশিষ্ট এক্স-রে দ্বৈত তারার পরিণতি এর পর্যায়কালের উপর নির্ভর করে। পর্যায়কাল এক বছরের কম হলে, পরিসমাপ্তির পর এটি নিউট্রন কেন্দ্রবিশিষ্ট একটি লোহিত দানব বা নিউট্রন তারায় পরিণত হতে পারে। পর্যায়কাল এর বেশি হলে, এটি যুগ্ম নিউট্রন তারকায় পরিণত হতে পারে, যদি বৃহৎ তারাটি সুপারনোভার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়। [১০]

মাইক্রোকোয়াসার সম্পাদনা

 
শিল্পীর কল্পনায় এসএস ৪৩৩ মাইক্রোকোয়াসার।

মাইক্রোকোয়াসার হচ্ছে একটি কোয়াসারের ছোট সংস্করণ। মাইক্রোকোয়াসার নামটি, কোয়াসার থেকে এসেছে। কোয়াসারের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে যেমন: শক্তিশালী এবং পরিবর্তনশীল রেডিও বিকিরণ, যা প্রায়ই একজোড়া রেডিও জেট আকারে ঘটে, এবং একটি এক্রেশন চাকতি যা পার্শ্ববর্তী উচ্চ ঘনত্ববিশিষ্ট কমপ্যাক্ট তারার (কৃষ্ণগহ্বর বা নিউট্রন তারকা) চতুর্দিকে তৈরি হয়। কোয়াসারে, কালো গহ্বরের আকার হয় অত্যন্ত বিশালাকার( লক্ষ লক্ষ সৌর ভর বিশিষ্ট); আর মাইক্রোকোয়াসারে, কমপ্যাক্ট তারার ভর হয় মাত্র কয়েক সৌর ভর। মাইক্রোকোয়াসারে শোষিত বস্তু একটি স্বাভাবিক দাতা তারকা থেকে আসে, এবং এক্রেশন চাকতিটি বর্ণালীর দৃশ্যমান আলো এবং এক্স-রে পাল্লায় খুবই উজ্জ্বল হয়। মাইক্রোকোয়াসারকে কখনও কখনও অন্যান্য এক্স-রে দ্বৈত থেকে আলাদা করতে রেডিও-জেট এক্স-রে দ্বৈত তারা বলা হয়। রেডিও বিকিরণের একটি অংশ আপেক্ষিক জেট থেকে আসে, যা প্রায়শই অতিআলোকীয় গতি প্রদর্শন করে। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

রিলেটিভিস্টিক জেটের গবেষণায় জন্য মাইক্রোকোয়াসার খুব গুরুত্বপূর্ণ। কমপ্যাক্ট তারার কাছাকাছি জেট গঠিত হয়। কম্প্যাক্ট তারার কাছে সময়ের পরিমাপ এদের ভরের সমানুপাতিক। অতএব, সাধারণ কোয়াসার যে অবস্থানে আসতে কয়েক শতাব্দী সময় নেয়, মাইক্রোকোয়াসারে তা একদিনেই হতে পারে।

উল্লেখযোগ্য মাইক্রোকোয়াসারের মধ্যে কয়েকটি হল এসএস ৪৩৩, যার পারমাণবিক বিকিরণ উভয় জেট থেকেই দৃশ্যমান, জিআরএস ১৯১৫+১০৫,যার উচ্চ গতিসম্পন্ন জেট রয়েছে এবং সিগন্যাস এক্স-১, যা গামা রশ্মি (E> ৬০ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট) পর্যন্ত বিকিরণ করে থাকে। কণা ত্বরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্বারা ভিএইচই ব্যান্ডের উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণাগুলির নির্গমন ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ( দেখুন ফার্মি ত্বরণ এবং ত্বরণের কেন্দ্রাতিগ প্রক্রিয়া )।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Tauris, Thomas M.; van den Heuvel, Ed (২০০৬)। "Chapter 16: Formation and evolution of compact stellar X-ray sources"। Compact stellar X-ray sourcesCompact Stellar X-Ray Sources। Cambridge Astrophysics Series। পৃষ্ঠা 623–665। arXiv:astro-ph/0303456 আইএসবিএন 978-0-521-82659-4ডিওআই:10.1017/CBO9780511536281.017 
  2. Weidenspointner, Georg (২০০৮)। "An asymmetric distribution of positrons in the Galactic disk revealed by gamma-rays": 159–62। ডিওআই:10.1038/nature06490পিএমআইডি 18185581 
  3. "Mystery of Antimatter Source Solved – Maybe" by John Borland 2008
  4. Introduction to Cataclysmic Variables (CVs), NASA, 2006.
  5. Chen, Wen-Cong; Podsiadlowski, Philipp (২০১৬)। "Evolution of Intermediate-mass X-Ray Binaries Driven by the Magnetic Braking of AP/BP Stars. I. Ultracompact X-Ray Binaries": 131। arXiv:1608.02088 ডিওআই:10.3847/0004-637X/830/2/131 
  6. Negueruela, I; Smith, D. M (২০০৬)। "Supergiant Fast X-ray Transients: A New Class of High Mass X-ray Binaries Unveiled by INTEGRAL": 165। arXiv:astro-ph/0511088  
  7. Sidoli, Lara; Ed van den Heuvel (২০০৮)। "Transient outburst mechanisms": 2892। arXiv:0809.3157  
  8. Liu, Q. Z; Van Paradijs, J (২০০৭)। "A catalogue of low-mass X-ray binaries in the Galaxy, LMC, and SMC (Fourth edition)": 807। arXiv:0707.0544 ডিওআই:10.1051/0004-6361:20077303 
  9. Tauris, Thomas M; Van Den Heuvel, Edward P. J (২০০০)। "Formation of Millisecond Pulsars with Heavy White Dwarf Companions:Extreme Mass Transfer on Subthermal Timescales": L93–L96। arXiv:astro-ph/0001013 ডিওআই:10.1086/312496পিএমআইডি 10655173 
  10. Podsiadlowski, Ph; Rappaport, S (২০০২)। "Evolutionary Sequences for Low- and Intermediate-Mass X-Ray Binaries": 1107। arXiv:astro-ph/0107261 ডিওআই:10.1086/324686 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা