আস্ত্রোনোমিয়া নোভা

ইয়োহানেস কেপলার রচিত একটি বই যা ১৬০৯ সালে প্রকাশিত হয়

আস্ত্রোনোমিয়া নোভা (লাতিন: Astronomia Nova) জার্মান জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ ইয়োহানেস কেপলারের লেখা বই যা ১৬০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। কেপলার ট্যুকোর অধীনে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথ নিয়ে গবেষণা করার সময় গ্রহীয় গতির প্রথম দুটি সূত্র সম্পর্কে ধারণা পান যার চূড়ান্ত রূপ এ বইয়ে প্রকাশিত হয়। এটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত একটি বই এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃত। এতে কোপের্নিকুসের সৌরকেন্দ্রিকতাবাদের পক্ষে শক্ত প্রমাণ তুলে ধরা হয় এবং প্রথম বারের মত গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা ব্যক্ত করা হয়।

১৬০৯ সালে প্রকাশিত আস্ত্রোনোমিয়া নোভার প্রচ্ছদ
কেপলারের আগে সর্বজন গৃহীত গ্রহীয় গতির তিনটি মডেল

পটভূমি সম্পাদনা

কেপলার ইকুয়েন্টের সাহায্যে মঙ্গলের কক্ষপথের বিভিন্ন রূপ বারবার হিসাব করেন যদিও কোপের্নিকুস তার সৌরকেন্দ্রিক মডেলের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ইকুয়েন্টকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কেপলার এই হিসাবের মাধ্যমেই এমন একটি মডেল তৈরিতে সক্ষম হন যার সাথে ট্যুকোর পর্যবেক্ষণের সর্বোচ্চ পার্থক্য মাত্র ২ আর্কমিনিট, যা গ্রহণযোগ্য সীমা। তারপরও জটিল এবং কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মডেলের কয়েকটি বিন্দু পর্যবেক্ষণ থেকে প্রায় ৮ আর্কমিনিট দূরে সরে যাচ্ছিল। চলিত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সঠিক মডেল তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে উপাত্তের সাথে ডিম্বাকার মডেল মেলানোর চেষ্টা শুরু করেন।[১]

বিশ্ব সম্পর্কে কেপলারের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সূর্যই ছিল সৌরজগৎের গতিদায়ক শক্তির উৎস এবং ঈশ্বরের প্রতীক। উইলিয়াম গিলবার্টের দে মাগণেতে (১৬০০) বইয়ে পৃথিবীর চৌম্বক আত্মার যে ধারণা প্রকাশিত হয়েছিল তার সাথে নিজের আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা এক করে এর একটি ভৌত ভিত্তিও দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। সূর্য থেকে বিকিরিত গতিদায়ক শক্তি (বা গতিদায়ক "প্রজাতি", motive species)[২] দূরত্বের সাথে সাথে কমতে থাকে যে কারণে গ্রহ সূর্যের কাছে এলে দ্রুত এবং দূরে গেলে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে চলে।[৩][৪] এই অণুমিতি গণিতের সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যার নিয়মনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহের অণুসূরঅপসূর পরিমাপের মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেন যে, কোন গ্রহের গতির হার সূর্য থেকে তার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। অবশ্য পুরো কক্ষপথের জন্য এই সূত্রের সত্যতা যাচাই করতে অনেক পরিমাপের দরকার ছিল। তাই ১৬০২ সালের মধ্যে সূত্রটিকে তিনি জ্যামিতিক রূপে নিয়ে আসেন: "গ্রহগুলো সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে" যা কেপলারের গ্রহীয় গতির দ্বিতীয় সূত্র নামে পরিচিত।[৫]

এরপর তিনি জ্যামিতিক ব্যস্তবর্গীয় নীতির সাহায্যে এবং ডিম্বাকৃতির কক্ষপথ ধরে নিয়ে মঙ্গলের পুরো গতিপথ হিসাব করার অভিযানে নামেন। অন্তত ৪০ বার ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ১৬০৫ সালে বুঝতে পারেন কক্ষপথের প্রকৃত আকৃতি উপবৃত্তের মত। উপবৃত্তের চিন্তা মাথায় আগেও এসেছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব বেশি সোজা হয়ে যায় যা পূর্বের জ্যোতির্বিদদের বোঝা উচিত ছিল- এই ভেবে তিনি ক্ষান্ত থাকতেন। মঙ্গলের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ পরিমাপের পরই তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, "সকল গ্রহ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে, যেখানে সূর্য থাকে উপবৃত্তের একটি ফোকাসে"- এরই নাম কেপলারের গ্রহীয় গতির প্রথম সূত্র। কিন্তু কোন সহযোগী নিয়োগ করেননি বিধায় মঙ্গল ছাড়া অন্য কোন গ্রহের কক্ষপথ আর পরিমাপ করা হয়নি তার। এই বছরের শেষ দিকে আস্ত্রোনোমিয়া নোভার পাণ্ডুলিপি রচনা শেষ করেন যাতে এ সমস্ত ফলাফল সন্নিবেশিত হয়। অবশ্য ট্যুকোর পর্যবেক্ষণ (যা তার উত্তরসূরীদের সম্পত্তি) ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট আইনগত জটিলতায় পড়ে ১৬০৯ সালের আগে এটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়নি।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Caspar, Kepler, pp.123–128
  2. On motive species, see: Lindberg, "The Genesis of Kepler's Theory of Light," pp.38–40
  3. "কেপলার খ-গোলকসমূহের সুষম বৃত্তীয় গতির পরিবর্তে দূরত্ব-বেগ সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রহের গতিপথ ব্যাখ্যা করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার মাধ্যমে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার উৎপত্তি ঘটে। কেবল নতুন মডেল তৈরির পরিবর্তে তিনি ভৌত সূত্রের মাধ্যমে গ্রহের গতিপথ প্রতিপাদন করেন। তাই বলা যায় ক্ষেত্রফল সূত্র আবিষ্কারের আগেই ভৌত নীতি হিসেবে সুষম বৃত্তীয় বেগের ধারণা পরিত্যাগ করেছিলেন।", Peter Barker and Bernard R. Goldstein, "Distance and Velocity in Kepler's Astronomy", Annals of Science, 51 (1994): 59–73, at p. 60.
  4. Koyré, The Astronomical Revolution, pp.199–202
  5. Caspar, Kepler, pp.129–132
  6. Caspar, Kepler, pp.131–140; Koyré, The Astronomical Revolution, pp.277–279