অজয় রায়

বাংলাদেশী পদার্থবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক ও মানবাধিকারকর্মী

অজয় রায় (১ মার্চ ১৯৩৫- ৯ ডিসেম্বর ২০১৯) বাংলাদেশি পদার্থবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী ছিলেন।

অজয় রায়
জন্ম১ মার্চ ১৯৩৫
মৃত্যু৯ ডিসেম্বর ২০১৯ (বয়স ৮৪)
জাতীয়তাবাংলাদেশি
মাতৃশিক্ষায়তনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লীডস বিশ্ববিদ্যালয়
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রপদার্থবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠানসমূহঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা ও কর্ম জীবন সম্পাদনা

স্কুল এবং কলেজ জীবনে পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাশ করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। অতঃপর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ১৯৬৭ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। দেশি এবং বিদেশি বহু জার্নালে তার অভিসন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছে[১][২][৩][তথ্যসূত্র প্রয়োজন]। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি পদে আসীন ছিলেন। তিনি আমৃত্যু সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং দক্ষিণ এশীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন। তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং মুক্তান্বেষার সম্পাদক ছিলেন। কলামিস্ট হিসবেও তিনি দৈনিক সমকালে লেখালেখি করতেন।[৪]। মৃত্যুর পূর্বাবধি তিনি বাংলা একাডেমির ৩ খণ্ডে ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থেও সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পাদনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক অজয় রায়ের বাংলাদেশের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন । সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসবে নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরসূরী হিসবে একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।[৫][৬]

মানবাধিকার সম্পাদনা

অধ্যাপক অজয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন‌ রোধে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।[৭][৮]২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন বৃদ্ধি পেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি মনিটরিং সেল গঠন করে বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিলে সংখ্যালঘুদের সহায়তা করেন। ইন্টারনেটে সংখ্যালঘুদের দুর্দশার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে' শিরোনামে সিরিজ শুরু করেন। ভোলার অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে বিভিন্ন নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং দাঙ্গায় যারা গৃহ হারিয়েছিল, তাদের গৃহ পুনর্নিমাণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।[৯] । অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের সাথে মিলে অধ্যাপক অজয় রায় ‘গণ তদন্ত কমিশন’ তৈরি করেন, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০০২ সালে। দেশের পাহাড়ি জনগণ এবং আদিবাসীদের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনও তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেন। তিনি মনে করেন, পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীবাঙালি অধিবাসীদেরকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়া দরকার।[১০][১১]

বিজ্ঞানমনস্কতা ও মুক্তবুদ্ধির প্রসার সম্পাদনা

অধ্যাপক অজয় রায় বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। তিনি বিজ্ঞানকে তরুণ প্রজন্মে বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেবার প্রয়াসে তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভার আয়োজন করে থাকেন। তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি মুক্তান্বেষা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসবে কাজ করেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। তিনি বাংলাদেশের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।[১২]। আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনারে পঠিত হয়েছে[১৩] । বাংলাদেশের মুক্তমনা এবং মুক্তচিন্তক লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ স্বতন্ত্র ভাবনা তার পরিচালনায় প্রকাশিত হয়েছে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে।

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

রচনাকর্ম সম্পাদনা

  • বিজ্ঞান ও দর্শন, জড়ের সন্ধানে (১৯৯৩-৯৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • আদি বাঙালি : নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭) [ইতিহাস পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত পুস্তক]
  • স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা), চারদিক, ২০০৮
  • লীলা নাগ : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি (সম্পাদনা), সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩।
  • পদার্থবিদ্যা ( সহ-অনুবাদক, মূল: রেসনিক, হ্যালিডে) (অনুবাদ এবং সম্পাদনা)
  • বাংলা একাডেমি বিজ্ঞানকোষ (প্রথম হতে পঞ্চম খণ্ড) (সম্পাদনা)
  • মুক্তান্বেষা ষাণ্মাসিক ম্যাগাজিন (সম্পাদনা), মুক্তমনাশিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ

মৃত্যু সম্পাদনা

অজয় রায় ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১৭][১৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Indian Journal of Physics and Proc of the Indian Assoc for the Cultivation of Science – A, আইএসএসএন 0019-5480, Vol: 73, Issue: 1,Date: 1999 ইত্যাদি
  2. "Rationalist International, Bulletin # 88"। ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০০৯ 
  3. "secularvoiceofbangladesh"। ২৯ অক্টোবর ২০০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভেম্বর ২০১৮ 
  4. "দৈনিক সমকালে অধ্যাপক অজয় রায়ের কলাম"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০০৯ 
  5. একাত্তুরে রণাঙ্গণ, শামসুল হুদা চৌধুরী
  6. মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভুমিকা, মেজর রফিকুল ইসলাম
  7. সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নারীভোটারদের নিরাপত্তা দেখভালে সম্প্রীতি মঞ্চ, দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ২৭, ২০০৮
  8. সুশীল সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবেলা করতে পারে, বিশেষ সাক্ষাৎকারে অজয় রায়, প্রথম আলো ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০০৪
  9. "দৃষ্টিপাতের ওয়েব সাইটে ভোলার বর্ণনা"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  10. 'পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নেয়া উচিত', বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম; এপ্রিল ২৪, ২০০৯[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  11. "আমাদের সময়, এপ্রিল ২৫, ২০০৯"। ২৭ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  12. বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণ, অজয় রায়, আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক গ্রন্থ (২০০১)
  13. Aroj Ali Matubbar: Rationalist Philosopher of Rural Bangladesh, Ajoy Roy, International Rationalist Conference in New Delhi, 2001
  14. একুশে পদক ২০১২, কালের কন্ঠ,[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  15. "বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার"বাংলা একাডেমি। ১৪ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০১৯ 
  16. "ইউজিসি প্রফেসর হিসেবে ইতঃপূর্বে যারা মনোনীত হয়েছেন তাদের তালিকা" (পিডিএফ)বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জুলাই ২০২১ 
  17. "অধ্যাপক অজয় রায় আর নেই"প্রথম আলো। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  18. "Prof Ajoy Roy, father of slain writer Avijit, dies at 84"bdnews24.com। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৯